র্যাগিং এবং ছাত্র সমাজ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
উত্তর:
র্যাগিং এবং ছাত্র সমাজ
একটি ভয়ংকর মানসিক তথা সামাজিক ব্যাধি। আদিম প্রবৃত্তির অদম্য জাগরণে মানবসমাজকে, তার শিক্ষা আর চেতনার অহংকারকে হতমান করে দেয় এই র্যাগিং । কলুষিত হয় শিক্ষার পবিত্র অঙ্গন। মানুষ গড়ার কারখানা হয়ে ওঠে পাশবিকতার অনুশীলন ক্ষেত্র। অভিধানে বিবর্ণ হয়ে যায় সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব, মনুষ্যত্বের মতাে শব্দগুলি।
‘র্যাগিং ’ একটি ইংরেজি শব্দ। সােজা কথায় এর অর্থ হল অকারণে অন্যকে হেনস্থা করে আনন্দলাভের প্রক্রিয়া। র্যাগিং -এর মূলে থাকে প্রভুত্বকামিতা, অন্যের উপরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। আবার, নিছক আনন্দলাভও এর উদ্দেশ্য হতে পারে। সমাজের যে-কোনাে স্তরেই র্যাগিং হতে পারে। পাড়ায় অথবা কর্মক্ষেত্রে কোনাে মানুষের অতিরিক্ত সারল্য বা স্বভাবের কোনাে সামান্য অসংগতির সূত্র ধরে তাকে নিয়ে মজা করার দৃশ্য সহজলভ্য। কখনও মানুষের দারিদ্র্য, কখনও তার সামাজিক অবস্থান ইত্যাদিকে উপহাস, ব্যঙ্গের বিষয় করা হয়। সামাজিক কর্তৃত্বের সুযােগ নিয়ে গ্রামীণ বিচারসভায় সামান্য কারণে অমানবিক নানা শাস্তিদানও এক ধরনের র্যাগিং । প্রাচীন বর্ণাশ্রম শাসিত সমাজে উচ্চবর্ণের দ্বারা শূদ্ৰশ্রেণির নিগ্রহে, উচ্চবর্ণের আত্মসুখ লাভের প্রবণতাতে সামাজিক র্যাগিং পরিলক্ষিত হয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্ষেত্ৰই র্যাগিং -এর অবাধ অনুশীলন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। মূলত সিনিয়র ছাত্রদের দ্বারা নবীনদের নানারকম শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার মধ্যেই শিক্ষাক্ষেত্রে র্যাগিং -এর প্রেক্ষিতটি নিহিত থাকে।
শিক্ষাক্ষেত্রে র্যাগিং নানা উপায়ে হতে পারে। প্রথমত, মৌখিক প্রক্রিয়া— এক্ষেত্রে নানা অদ্ভুত প্রশ্ন করে উত্তর চাওয়া হয় এবং তা না দিতে পারায়। দলবদ্ধ উল্লাস ও ব্যঙ্গ আবর্তিত হয় কোনাে একটি ছাত্রকে ঘিরে। দ্বিতীয়ত, শারীরিকভাবে অত্যাচার করা হয় বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেটের ছেকা, বরফের টুকরাে খেতে বাধ্য করা, বিশেষ ভঙ্গিমায় দাঁড় করিয়ে রাখা ইত্যাদি। কখনও জোর করে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করতে বাধ্য করা হয়। ‘লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচিত ছাত্র বা ছাত্রীটিকে। এই শারীরিক অত্যাচার প্রায়শই যৌন নিপীড়নের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, সব থেকে বেশি র্যাগিং হয়ে থাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে। কিন্তু মেডিকেল কলেজ বা অন্যান্য কলেজ ও শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতেও যথেষ্ট ব্যাগিং-এর ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত না র্যাগিং হয়, তার থেকে এর কুপ্রভাব বেশি লক্ষ করা যায় ছাত্রাবাসগুলিতে।
র্যাগিং -এর ফলাফল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শারীরিক কষ্টের থেকেও মানসিক আঘাত এক্ষেত্রে তীব্র হয়ে ওঠে। অনেকেই শরীর-মনের বিধ্বস্ত অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন চোখে এঁকে মেধাবী যে ছাত্রছাত্রীরা পরম আকাঙ্খিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় পা রাখে, র্যাগিং -এর বিষময় গ্রাসে তা কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অনেকে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদের শিকার হয়, এমনকি আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হয়। ২০০৫-০৬ এবং ২০০৬০৭, এই দুবছরের পরিসংখ্যানে র্যাগিং -এর কারণে ১১ জনের মৃত্যু, ১০ জনের আত্মহত্যা, ২৩ জনের শারীরিক আঘাত, ১২ জনের মানসিক অবসাদ এবং ৫ জনের শিক্ষাক্ষেত্র ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এই পরিসংখ্যান সভ্য সমাজের লজ্জা। এ ছাড়া প্রচারের বাইরে থেক্যোওয়া এরকম আরাে বহু অমানবিক ঘটনা এই পরিসংখ্যানকে আরও নিন্দনীয় করে তুলবে সন্দেহ নেই।
এই সামাজিক তথা মানসিক ব্যাধির গ্রাস থেকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। দেখা ছাত্রছাত্রীদের মুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিংকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছে। এই নির্দেশ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে র্যাগিং প্রতিরােধের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার রাঘবন কমিটি তৈরি করেছিল। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্ট র্যাগিং-এর ঘটনাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে নির্দেশ দেয়। ইউজিসি-ও র্যাগিং প্রতিরােধে সুনির্দিষ্ট বিধি কার্যকর করেছে। সরকারি এইসব প্রচেষ্টার পাশাপাশি গড়ে উঠেছে ‘সােসাইটি এগেইনস্ট ভায়ােলেন্স ইন এডুকেশন’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও। প্রশাসনিক সতর্কতা অনেকটাই বেড়েছে। ২০১০-এর ডিসেম্বরে দুর্গাপুরে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে র্যাগিং-এর ঘটনায় ৪ ছাত্রীর গ্রেফতার কিংবা ২০১১র জানুয়ারিতে একই অপরাধে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন ছাত্রের শাস্তি যার উদাহরণ। কিন্তু র্যাগিং প্রতিরােধ করতে সামগ্রিক সচেতনতা ও শুভবুদ্ধির জাগরণ দরকার। আইনের কঠোরতার পাশাপাশি আদর্শবাদী এক সুস্থ। সামাজিক পরিবেশও ছাত্রদের দিতে হবে।
চণ্ডীগড়ের এ ভি নগেন্দ্র, চেন্নাই-এর সিনমই দেবরাডা, তিরুবনন্তপুরম-এর এ অজিত-এর মতাে মেধাবী ছাত্ররা নিকট অতীতে র্যাগিং-এর কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। কবির কথায়——“এ আমার, এ তােমার পাপ”। র্যাগিং-এর নাগপাশ থেকে শিক্ষাঙ্গনকে মুক্ত করতে হবে। সহমর্মিতা আর বন্ধুত্বের অমলিন আলােয় শিক্ষাক্ষেত্রকে আলােকিত করার দায়িত্ব সমাজের সকলের সাহায্যে ছাত্রসমাজকেই নিতে হবে।
আরো পড়ুন
সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরােধে ছাত্রসমাজের ভূমিকা | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
ছাত্রজীবনে সৌজন্য ও শিষ্টাচার | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
বিশ্ব উষ্ণায়ন | মানস মানচিত্র অবলম্বনে বাংলা প্রবন্ধ রচনা
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।