সামাজিক পরিবর্তন বলতে কী বােঝাে ? সামাজিক পরিবর্তনের উপাদানগুলি আলােচনা করাে। “শিক্ষা হলাে সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার” – ব্যাখ্যা করাে। 4+8+8
উত্তর:
সামাজিক পরিবর্তন:-
সামাজিক পরিবর্তন মূলত একটি সমাজের সার্বিক ব্যবস্থার পরিবর্তনকে বোঝায়। এতে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তির আচার-আচরণ বা সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন হয়। এটি আর্থ-সামাজিক কাঠামোর একটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। সামাজিক পরিবর্তন কিছু জায়গায় দ্রুত হতে পারে আবার কিছু জায়গায় ধীর হতে পারে।
তবে, সামাজিক পরিবর্তন একটি সার্বজনীন বিষয়। এটি যেকোন সময় যেকোন স্থানে হতে পারে। তবে, কিছু সামাজিক পরিবর্তন দীর্ঘ সময়ের নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তীত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর।
সামাজিক পরিবর্তন এর উপাদান:-
চারটি মূল উপাদান সামাজিক পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে তা হল পরিবেশ, প্রযুক্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং জনসংখ্যা। এছাড়া অন্যন্য উপাদানগুলো হল, প্রাকৃতিক উপাদান, জৈবিক উপাদান, সাংস্কৃতিক উপাদান, শিক্ষা, প্রযুক্তি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ ইত্যাদি।
সামাজিক পরিবর্তনের উপাদানগুলি সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল-
সাস্কৃতিক উপাদান:- সামাজিক পরিবর্তনের একটি অন্যতম উপাদান হল সংস্কৃতি। সমাজের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, মানুষের মূল্যবোধের পার্থক্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শের ভিন্নতা প্রভৃতি সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান যা সমাজের মধ্যে নানা রকমের পরিবর্তন সৃষ্টি করে।
প্রাকৃতিক উপাদান:- ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থান সামাজিক পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে। ধীর এবং আকস্মিক ভৌগোলিক পরিবর্তন যেমন জলবায়ু সংক্রান্ত পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রভৃতি মানুষের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলে। এর ফলে সমাজের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। মানুষ এসব সমস্যা মোকাবিলায় নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে সমাজের পরিবর্তন সাধন করে।
জৈবিক উপাদান:- জৈবিক উপাদান বৃদ্ধি বা হ্রাস, স্থানান্তর অথবা ঘনত্বের পরিবর্তন সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বেকারত্ব, শিশুশ্রম ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার মতো নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষা:- শিক্ষা হলো এক ধরনের সংস্কার সাধন ও বিরামহীন প্রক্রিয়া। এটি সমাজে সদস্যদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার আত্মবিশ্বাস ও বিচার বিবেচনার ক্ষমতা জাগ্রত করে। শিক্ষায় যাবতীয় অজ্ঞতা, কুসংস্কার প্রভৃতি থেকে মুক্তি দেয়। বর্তমানে সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষা বিরাট ভূমিকা রেখে চলছে। এখন ঘরে বসেও দূরবর্তী কোন দেশের শিক্ষা লাভ করা সম্ভব।
যোগাযোগ:- যে দেশের যোগাযোগ মাধ্যম যত উন্নত সে দেশের অর্থনীতিও তত উন্নত। উন্নত যোগাযোগ সামাজিক পরিবর্তনের একটি অন্যতম উপাদান। এই যোগাযোগ বিভিন্নভাবে হতে পারে যেমন জল,স্থল ও আকাশপথে যোগাযোগ। এছাড়া টেলিফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ডিস এন্টেনা, মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা প্রভৃতি সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।
শিল্পায়ন ও নগরায়ণ:- শিল্পায়ন ও নগরায়ন অর্থনৈতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটায়। শিল্প এলাকায় মানুষের কর্মক্ষেত্র তৈরী হয়। ফলে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। নগরায়ণের মাধ্যমে মানুষের কর্মের ক্ষেত্র তৈরী, আর্থিক সচ্ছলতা আনয়ন, এবং বেকারত্ব দূর করা যায়। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পর এর প্রভাবে সারা পৃথিবীতে শিল্পায়ন ও নগরায়ন বৃদ্ধি ঘটে।
প্রযুক্তি:- প্রযুক্তি হল বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক। প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং এর প্রসারের মাধ্যমে সমাজব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মানসিক গঠন এবং সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমন- বেতারের আবিষ্কার সামাজিক জীবনে আমোদ- প্রমোদের ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনীতি এবং অন্যান্য আরও বহু ধরনের সামাজিক কাজকে প্রভাবিত করেছে। মোটর ইঞ্জিন আবিষ্কার আজ সামাজিক সম্পর্কের পরিধিকে বিস্তৃত করেছে।
“শিক্ষা হলো সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার” কারন:-
সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে সমাজের রূপান্তর বা রদবদল। সমাজের এ পরিবর্তন, রূপান্তর বা রদবদলের কতগুলো কারণ রয়েছে। যেমনঃ
ভৌগোলিক কারণঃ ভৌগোলিক পরিবেশ ও ভৌগলিক অবস্থা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনুকূল ভৌগলিক পরিবেশে সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। ভৌগলিক ও জলবায়ুর পরিবর্তনে সামাজিক পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমনঃ কোনো নদী শুকিয়ে গেলে এর তীরবর্তী মৎস্যজীবীদের পেশা পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। নদী ভাঙন বা ক্রমবর্ধমান জলবায়ুর পরিবর্তন নগর-স্থানান্তরকে উৎসাহিত করে।
আন্দোলনঃ সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে আন্দোলন বা বিপ্লব। সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবা বিবাহের প্রচলন, নারী শিক্ষা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন বিলোপ ইত্যাদি সংস্কার সাধিত হয়েছে। ফরাসি, বিপ্লব সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা, শ্রেণি ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের আমূল পরিবর্তন করেছে। গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, নারীর সমতা (জেন্ডার), পরিবেশ, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে আন্দোলন মানুষকে অধিকার সচেতন করে যা সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরাণ্বিত করছে।
উৎপাদন ব্যবস্থাঃ দীর্ঘমেয়াদে সমাজের দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধনে উৎপাদন ব্যবস্থার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দাস নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা হতে সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থায় উত্তরণের মাধ্যমে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল। একইভাবে সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উত্তরণের মাধ্যমেও সমাজের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কৃৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রামীণ সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু শিল্পোৎপাদন এবং সেবাখাত নগর সমাজের বৈশিষ্ট্য। কোনো সমাজে ব্যাপকভাবে শিল্পায়ন হলে সেখানে নগরায়ন ত্বরান্বিত হয়। ফলে সমাজ সনাতন ব্যবস্থা থেকে আধুনিকায়নের দিকে অগ্রসর হয়।
শিক্ষাঃ সামাজিক পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। অজ্ঞতা, অন্ধত্ব, কুসংস্কার ইত্যাদি হতে মুক্তি দিয়ে শিক্ষাই মানুষকে সমাজোপযোগী করে তোলে। এ জন্য শিক্ষা সামাজিকীকরণের প্রধান মাধ্যম। শিক্ষা একটা সমাজ ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে পারে। শিক্ষা মানুষের পেশা, রুচি, আচার-আচরণ, মূল্যবোধ এবং আর্থিক সক্ষমতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
সরকার ও রাজনীতিঃ সামাজিক পরিবর্তনে সরকার ও রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রত্যয়। ভারতীয় সামাজিক পরিবর্তনে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা ধর্মীয় মৌলবাদ, প্রগতিশীলতা কিংবা সাম্প্রদায়িকতা সমাজকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক সরকার এবং সামরিক সরকারের শাসনামলে সমাজে অনেক পার্থক্য ও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয় মৌলবাদী আদর্শের রক্ষণশীল সরকার ও প্রগতিশীল সরকারের শাসনামলেও সমাজের স্বাতন্ত্র ধারার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
ধর্মীয় চেতনাঃ ধর্মীয় চেতনার যৌক্তিকতার বিকাশ সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক। সমাজে যখন নানারকম অনাচার, অসামাজিকতা বৃদ্ধি পায় তখন ধর্মীয় চেতনা ও আদর্শ সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারে। মুহাম্মদ (সা.), যীশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ ধর্মীয় চেতনা ও আদর্শের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটনে সক্ষম হয়েছিলেন।
প্রচার-প্রচারণাঃ কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে ব্যাপক প্রচার – প্রচারণা চালানো হলে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনও অনিবার্য হয়ে পড়ে। স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিদেশী পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার ব্রিটিশ ভারতের সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন এনেছিল। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে বহুমুখী প্রচারণার ফলে সমাজের নেতৃত্ব, ক্ষমতা কাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বাল্যবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রচারণাও সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।
গণমাধ্যমঃ আধুনিক সমাজের অনিবার্য উপাদান হচ্ছে গণমাধ্যম। পত্র – পত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক পরিবর্তনে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম জনমত গঠন এবং সামাজিক আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে গণমাধ্যম পরিবর্তন আনয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সামাজিক পরিবর্তনের পূর্বশর্ত বলা যেতে পারে। ভাষাগত কিংবা অবকাঠামোগত যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন খুব অনুন্নত ছিল তখন সমাজও ছিল বদ্ধ, স্থির এবং অনগ্রসর। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত হয়েছে সামাজিক পরিবর্তনও তত দ্রুততর হয়েছে। গ্রামের সাথে শহরের সড়ক, রেল বা জলপথের যোগাযোগ নিশ্চিত হলে গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হতে বাধ্য। উত্তরবঙ্গ মঙ্গা নিরসনে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। টেলিফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি যোগাযোগ ব্যবস্থা সমাজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নঃ ঐতিহ্যবাহী সমাজ থেকে আধুনিক সমাজে উত্তরণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান সর্বাধিক। বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে আজকের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সামাজিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর্থ – সামাজিক উন্নয়ন, উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন, সামাজিক সম্পর্ক ও শ্রেণি, পেশা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব অনস্বীকার্য।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।