শিক্ষার বহুবিধ লক্ষ্যগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে

শিক্ষার বহুবিধ লক্ষ্যগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে  Class 11 | শিক্ষার ধারণা ও লক্ষ্য (Education) 8 Marks

উত্তর:

শিক্ষার বহুবিধ লক্ষ্যসমূহ : লক্ষ্য হল কোনাে উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সচেতন প্রক্রিয়া। এটি হল এমন একটি অভিপ্রায় যার সাপেক্ষে আমরা আমাদের প্রচেষ্টাগুলিকে পরিচালনা করি। মানুষের মধ্যে আচরণ ধারার পরিবর্তন আনতে চাইলে, সামনে একটি লক্ষ্য স্থির করতে হয়। লক্ষ্যই শিক্ষার মধ্যে গতি আনে এবং শিক্ষামূলক প্রচেষ্টার তাৎপর্য নির্ধারণ করে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জীবন ও সমাজের প্রয়ােজনের তাগিদে শিক্ষার নানান লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। এখানে কিছু লক্ষ্য সংক্ষেপে আলােচনা করা হল :  

[1] জ্ঞানমূলক লক্ষ্য : সব দেশে সবকালেই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল জ্ঞানার্জন। বিশিষ্ট দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন—“Knowledge is power by which things are done’ অর্থাৎ জ্ঞান হল এমন এক ধরনের শক্তি বা ক্ষমতা যার দ্বারা আমরা বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে পারি। এই কারণে বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীর জ্ঞানমূলক বিকাশের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। 

[2] বৃত্তিমূলক লক্ষ্য : শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্যের মূল কথা হল শিশুকে জীবনের শুরু থেকেই বৃত্তির জন্য উপযােগী করে গড়ে তােলা। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে হলে ব্যক্তিকে উপার্জন করতে হয়। উপার্জনের জন্য বৃত্তিশিক্ষার দরকার হয়। আগে পরিবারই তার সদস্যদের বৃত্তিশিক্ষা দান করত। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রচলন ঘটেছে। 

[3] নৈতিক লক্ষ্য : শিক্ষার নৈতিক লক্ষ্যের মূল কথা হল শিক্ষার্থীর নৈতিক মানের বিকাশসাধন করা এবং তাকে আদর্শ চরিত্রের অধিকারী করে তােলা। শিক্ষার মাধ্যমে যদি শিশুকে ন্যায়-অন্যায়, ভালােমন্দ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদির সঙ্গে প্রথম থেকেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব না-হয়, তাহলে পরবর্তীকালে ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে তার সুদূরপ্রসারী ফল খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বিভিন্ন দেশে শিক্ষার নৈতিক লক্ষ্যের গুরুত্ব আরােপ করা হয়। 

[4] অভিযােজনমূলক লক্ষ্য : শিক্ষার অভিযােজনকমূলক লক্ষ্যের মূলকথা হল শিশুকে যে-কোনাে পরিস্থিতিতে সার্থক অভিযােজনে সক্ষম করে তােলা। শিশু যদি নিজেকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে সার্থকভাবে মানিয়ে নিতে না-পারে, তাহলে তার পক্ষে পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। শিশুকে কেবলমাত্র বাহ্যিক জগতের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় সামর্থ্যসম্পন্ন করে গড়ে তুললেই হবে না, শিশু যাতে তার বাহ্যিক জগৎ ও অন্তর জগতের মধ্যে সংগতিবিধানের মাধ্যমে সুস্থ জীবনের অধিকারী হতে পারে, তার উপযােগী করে গড়ে তুলতে হবে। এটিই হল শিক্ষার অভিযােজনমুলক লক্ষ্য।

[5] আধ্যাত্নিক লক্ষ্য : ভাববাদী দার্শনিকদের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর মনে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত করা। তাদের মতে, প্রতিটি ব্যক্তি পরমব্রত্মের অংশ, ব্যক্তিকে সেই পরমব্রত্মের স্বরূপ উপলদ্ধি করানােই হল শিক্ষার লক্ষ্য। প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার লক্ষ্যও ছিল আত্মােপলব্বি। বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধি প্রমুখ আধুনিক ভারতীয় শিক্ষাবিদগণও ব্যক্তির আধ্যাত্মিক বিকাশকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের কথা বলেছেন। পরমসত্য, পরমজ্ঞান ও পরমআনন্দের উপলব্বি একমাত্র আধ্যাত্মিক শিক্ষার মধ্য দিয়েই সম্ভব। 

[6] সংস্কৃতিমূলক লক্ষ্য : শিক্ষার সংস্কৃতিমূলক লক্ষ্যের মূলকথা হল শিশুকে তার সংস্কৃতির সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ব্যক্তি তার দীর্ঘদিনের জীবনপরিক্রমায় যেসকল অভিজ্ঞতা, আচার-আচরণ, রীতিনীতি, মূল্যবােধ ইত্যাদি আয়ত্ত করেছে তার সব কিছুই সংস্কৃতির অন্তর্গত। সমাজের সদস্য হিসেবে ব্যক্তিকে সংস্কৃতির অন্তর্গত বিষয়গুলিকে মেনে চলতে হয় এবং পরের প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। শিক্ষার মাধ্যমেই এটি ঘটে। তাই একে শিক্ষার সংস্কৃতিমূলক লক্ষ্য বলা হয়। 

[7] বৃদ্ধি ও বিকাশমূলক লক্ষ্য : আধুনিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল বাতি পথে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করা। আধুনিক ভারতীয় শিক্ষায় বর্তমানে তিন ধরনের বিকাশের ওপর অধিক গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। এগুলি হল—ব্যক্তিগত বিকাশ, সামাজিক বিকাশ এবং জাতীয় বিকাশ। যে-কোনাে দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই তিন ধরনের বিকাশ অপরিহার্য। 

[8] চরিত্রগঠনের লক্ষ্য : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অগণিত শিক্ষাবিদ শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে চরিত্রগঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। ব্যাপক অর্থে, চরিত্র বলতে মানুষের সর্বাপেক্ষা উত্তম ও উন্নত গুণাবলিকে বােঝায়। উন্নত চরিত্রের ব্যক্তিমাত্রেই হিংসা-দ্বেষ, ক্রোধ, ভীতি ও কার্পণ্যের উর্ধ্বে উঠতে পারেন। সত্য কথা বলা, সৎপথে চলা, আত্মসংযম, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমা ইত্যাদি। 

যা-কিছু সামাজিক গুণাবলি বিকাশের সহায়ক সবই উন্নত চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত। আধুনিক বিশ্বকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে চরিত্রগঠনের ওপর জোর দিতে হবে। গান্ধিজির মতে, ‘চরিত্র গঠনই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য’ (The end of knowledge must be the building of character.) শিক্ষার বহুবিধ লক্ষ্য সম্পর্কিত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বলা যায় যে, শিক্ষার কোনাে একটি লক্ষ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এক-এক ধরনের লক্ষ্য এক-এক ধরনের দিকনির্দেশ করে এবং উদ্দেশ্যসাধনে সহায়ক হয়। তাই এই লক্ষ্যগুলির কোনাে একটিকে যেমন শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় , তেমনি এগুলিকে বাদ দেওয়াও যায় না।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment