শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে কী বােঝ | শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য গ্রহণের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি আলােচনা করা

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে কী বােঝ | শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য গ্রহণের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি আলােচনা করা। 2 + 6   Class 11 | শিক্ষার ধারণা ও লক্ষ্য (Education) 8 Marks

উত্তর:

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য : শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যে ব্যক্তির বিকাশ বা ব্যক্তি উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই তত্ত্বে, সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে ব্যক্তিকে অধিক গুরুত্বদানের কথা বলা হয়েছে। আগে ব্যক্তি, পরে সমাজ। সমাজের প্রয়ােজনে ব্যক্তি নয় বরং ব্যক্তির প্রয়ােজনেই সমাজ গঠিত হয়েছে। একদল ব্যক্তি নিয়েই সমাজ গড়ে ওঠে। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সমাজের আলাদা কোনাে অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী শিক্ষাবিদগণ শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশকেই শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলেছেন। শিশুর শিক্ষা হবে তার ইচ্ছা, চাহিদা, প্রবণতা, সামর্থ্য প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে। এ বিষয়ে সক্রেটিসের উক্তি উল্লেখ্য। তিনি বলেছেন—“Man is the root of mankind. Man is the measure of all things.’ অর্থাৎ মানবপ্রজাতির মূলে আছে মানুষ। সকল বিষয়ে মানুষই একমাত্র বিবেচ্য। রাধাকৃয়ন কমিশন (১৯৪৮-৪৯)-এর রিপাের্টেও বলা হয়েছে—“We must train people not merely to be citizens but also to be individuals, অর্থাৎ আমরা জনগণকে কেবলমাত্র নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দেব না, বরং উপযুক্ত ব্যক্তি হওয়ারও শিক্ষা দেব। মােটকথা ব্যক্তির ওপর প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, তাই হল শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য। 

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সপক্ষে যেসকল শিক্ষাবিদ এবং দার্শনিক অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্যযােগ্য কয়েকজন হলেন—প্লেটো, সক্রেটিস, স্যার পার্সিনান, কান্ট, বাট্রান্ড রাসেল, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ। 

শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সপক্ষে যুক্তি : শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সপক্ষে যেসকল যুক্তি রয়েছে, সেগুলি এখানে সংক্ষেপে আলােচনা করা হল :

[1] ভাববাদী দার্শনিকদের যুক্তি : ভাববাদী দার্শনিকদের মতে, জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। সেইজন্য মানুষের মধ্যে সত্য, শিব ও সুন্দরকে উপলব্ধি করার একটা ইচ্ছা রয়েছে। শিক্ষাই মানুষের সেই ইচ্ছাপূরণের সহায়তা করে। কেবলমাত্র আত্মােপলব্ধির দ্বারাই মানুষ জীবনের চরম সত্য অর্থাৎ ব্ৰত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে। আত্মােপলব্বির মাধ্যমেই মানুষ শােক, দুঃখ, জরা-ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পায়। এর ফলে ব্যক্তির কল্যাণ সাধিত হয়। 

[2] প্রয়ােগবাদী দার্শনিকদের যুক্তি : প্রয়ােগবাদী দার্শনিকদের মতে, চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই। জগতে সবকিছুই নিয়ত পরিবর্তনশীল। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের পরিবর্তন হয়। মানুষের চিন্তাধারারও পরিবর্তন হয়, সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে যায়। চিরন্তন সত্য বলে যদি আমরা কোনাে ধারণা বা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকি তাহলে আমরা যুগের পরিবর্তনের সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারব না। কাজেই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ যে সত্যকে আবিষ্কার করে, তাই হল প্রকৃত সত্য এবং এই জাতীয় সত্যের দ্বারাই সে তার জীবনের বহুমুখী সমস্যার সার্থক সমাধান করতে সক্ষম হয়। তাই প্রয়ােগবাদীরা শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা, চাহিদা, সামর্থ্য, প্রবণতা প্রভৃতির ওপর গুরুত্বদানের কথা বলেছেন। 

[3] প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের যুক্তি : প্রকৃতিবাদী দার্শনিকদের মতে, শিশুর শিক্ষা হবে তার আপন অভিরুচি, আগ্রহ, চাহিদা ও প্রবণতা অনুযায়ী। মানবসমাজ একটি কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান, ওই প্রতিষ্ঠান অনেকক্ষেত্রেই শিশুকে কলুষিত করে। তাই প্রকৃতিবাদীদের অভিমত শিশু স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাকৃতিক জগৎ থেকে শিক্ষালাভ করবে। জড়প্রকৃতি ও শিশুর প্রকৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ স্যার পার্সিনান বলেছেন যে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের উপযােগী অনুকূল পরিবেশ রচনাতেই শিক্ষার কাজকর্মকে সীমাবদ্ধ রাখা দরকার। প্রকৃতিবাদীদের মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হবে ‘আত্ম-অভিব্যক্তি’ ও ‘আত্ম-সংরক্ষণ। মােটকথা, প্রকৃতিবাদ অনুযায়ী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিসত্তার বিকাশ।

[4] জীববিজ্ঞানীদের যুক্তি : শিশু জন্মসূত্রে পূর্বপুরুষের জিন পায়। এর ফলে শিশুদের মধ্যে ব্যক্তিগত বৈষম্য দেখা দেয়। ফলে ব্যক্তিগত বৈষম্য অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণ করা। মােটকথা, শিশুর প্রবণতা, সামর্থ্য, প্রবৃত্তি, পছন্দ-অপছন্দের প্রতি নজর দিয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। 

[5] মনােবিজ্ঞানীদের যুক্তি : বিভিন্ন মনােবিজ্ঞানীগণও শিক্ষায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদকে সমর্থন করেছেন। মনােবিজ্ঞানীদের মতে, এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির তুলনায় আলাদা। কেবল দৈহিক দিক থেকে নয় তারা মানসিক, প্রক্ষোভিক প্রভৃতি দিক দিয়েও একে অপরের থেকে আলাদা। তাই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হবে ব্যক্তিসত্তার বিকাশসাধন।

উপরােক্ত আলােচ্য যুক্তিগুলির সাপেক্ষে বলা যায়—ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যক্তির বিকাশকে নানানভাবে ত্বরান্বিত করে। তাই ব্যক্তির উন্নয়ন বা বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার লক্ষ্যই আদর্শ মতবাদ।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment