জয়প্রকাশ নারায়ণের গণতন্ত্রের ধারণাটি আলোচনা করো

উত্তরঃ-

ভুমিকাঃ

ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে জয়প্রকাশ নারায়ন বিংশ শতাব্দীতে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর লেখা Why Socialism, From Socialism to Sarvodaya, Democratic Socialism, Reconstruction of Indian Polity প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে অন্যতম হল গণতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা।

জয়প্রকাশ নারায়নের মতে গণতন্ত্রঃ

লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের জন্য নিবেদিত প্রাণ। সমাজবাদী গণতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য জয়প্রকাশ জীবনভর নিরলস সংগ্রামের সামিল হয়েছেন। গণতন্ত্রের প্রতি প্রবল আকষর্ণের পরিপ্রেক্ষিতে জয়প্রকাশ নারায়ন গণতন্ত্র এবং তার সমস্যা ও  সাফল্য বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। গণতন্ত্র সম্পর্কে তার চিন্তাধারা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি দেখা যায়। যেমন-

ক) প্রচলিত গণতন্ত্রের বিরোধিতাঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ পশ্চিমী দেশগুলিতে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতানুসারে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা হল কার্যত নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র। তাঁর অভিমত অনুযায়ী সকল সরকারই হল মূলত অভিজাততান্ত্রিক প্রকৃতির। এই সমস্ত শাসনব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষ অবশিষ্ট সকলকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ গণতন্ত্রে জনগণ শাসক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়না। 

খ) দলহীন গণতন্ত্রঃ জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক দলসমূহ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে কার্যকর করার ব্যাপারে সক্রিয় হয়না। গণতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুসারে দলগুলি পরিচালিত হয় না। ক্ষমতার জন্য রাজনীতিক দলের লাগামছাড়া লোভ গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে। গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য নয়। ভারতে দলব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত নির্বাচনগুলি গণতন্ত্রের স্বার্থের বিচারে ক্রমান্বয়ে অধিকতর অপ্রাসঙ্গিক প্ৰতিপন্ন হচ্ছে। এই কারণে জয়প্রকাশ নারায়ণ দলহীন গণতন্ত্রের উপর জোর দিয়েছেন।

গ) গণতন্ত্র একটি জীবনধারাঃ জয়প্রকাশ নারায়ণের গণতন্ত্র হল একটি জীবনধারা। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের জীবনধারার মধ্যেই গণতন্ত্রের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। জনজীবনের আর্থ- সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র সম্প্রসারিত। গণতন্ত্রকে জনসাধারণের উদ্যোগ-আয়োজন ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে পাওয়া যায়। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের সংঘ-সংগঠন ও কার্যধারার মধ্যে গণতান্ত্রিক কার্যপ্রক্রিয়ার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ কেবল সরকারী কাজকর্মে মানুষের অংশগ্রহণ বা রাজনীতিক অধিকারের মধ্যে গণতন্ত্রের তাৎপর্য সীমাবদ্ধ নেই।

ঘ) গণতান্ত্রিক ব্যর্থতাঃ জয়প্রকাশ নারায়ণের অভিমত অনুসারে সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী, দরিদ্র কোথাও গণতন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক বা সাম্যবাদী ব্যবস্থায় কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়। অন্যদিকে পশ্চাদপদ ও দরিদ্র দেশগুলিতে গণতন্ত্রের সমস্যা-সংকট ভিন্ন প্রকৃতির। দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতি ও পরনির্ভরশীলতা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তোলে। ভারতে মত উন্নয়নশীন দেশগুলিতে জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, অর্থনীতিক অনগ্রসরতা প্রভৃতি গণতন্ত্রের সার্থকতার পথে একটি বড় বাধা।

ঙ) অংশগ্রহণকারী নৈতিক গণতন্ত্রঃ

জয়প্রকাশ নারায়ণের মতানুসারে অংশগ্রহণকারী নৈতিক গণতন্ত্রই হল আসল গণতন্ত্র। তাই জয়প্রকাশ নারায়ণ অংশগ্রহণকারী নৈতিক গণতন্ত্রের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গণতন্ত্রের সার্থকতা ও সাফল্যের স্বার্থে জনসাধারণকে সহায়ক নৈতিক গুণ ও মানসিকতার অধিকারী হতে হবে। অন্যথায় গণতন্ত্রের সাফল্য লাভ করতে পারবে না। গণতন্ত্রের স্বার্থে ব্যক্তি- মানুষের চাহিদাকে সীমাবদ্ধ করা দরকার। ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে এবং সকলকে দায়িত্ব গ্রহণে ইচ্ছুক, ও সক্ষম হতে হবে। সর্বোপরি ব্যক্তিবর্গকে শোষণ-পীড়ন ও স্বৈরাচারের বিরোধিতায় সোচ্চার হতে হবে।

উপসংহারঃ

জয়প্রকাশ নারায়ণ বিশ্বাস করতেন যে সমাজবাদ ছাড়া গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র ছাড়া সমাজবাদ সম্পূর্ণ ও সার্থক হতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সফল করে তোলা সম্ভব। এ বিষয়ে আধুনিককালের রাষ্ট্র-দার্শনিকরা জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করেন। কিন্তু সমালোচকদের মতানুসারে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের উপায়-পদ্ধতি সম্পর্কিত জয়প্রকাশ নারায়ণের আলোচনার সীমাবদ্ধতা অস্বীকার করা যায় না। গণতান্ত্রিক কর্মসূচির বাস্তবায়নের বিষয়টি বহুলাংশে অবহেলিত হয়েছে। স্বভাবতই গণতান্ত্রিক সমাজ সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা অনেকংশে কল্পণাশ্রয়ী হয়ে পড়েছে।

Read Also

ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment