তুলনামূলক শিক্ষার উপাদান হিসাবে প্রাকৃতিক উপাদান আলোচনা করো
উত্তর :
বিভিন্ন উপাদানের উপর ভিত্তি করে তুলনামূলক শিক্ষা গড়ে উঠেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য উপাদান তুলনামূলক শিক্ষার উপর প্রভাব ফেলে। এই উপাদানসমূহই ব্যক্তি বা সমাজের উপর কমবেশি প্রভাব বিস্তার করে। সাধারণভাবে নিম্নলিখিত উপাদানগুলি তুলনামূলক শিক্ষা বিকাশে প্রভাব বিস্তার করে। Prof N. Hans-এর মতে তুলনামূলক শিক্ষার উপাদানগুলি তিনটি ভাগে বিভক্ত। যথা— 1) প্রাকৃতিক উপাদান, 2) আধ্যাত্মিক উপাদান, 3) ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান।
তুলনামূলক শিক্ষার উপাদান হিসাবে প্রাকৃতিক উপাদান
কতকগুলি প্রাকৃতিক উপাদান তুলনামূলক উপাদানকে তথা বিকাশকে প্রভাবিত করে। এই বিষয়গুলি একাধারে প্রাকৃতিক ও সমাজনির্ভর। এইসব উপাদানের সঙ্গে যুক্ত নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ—(ক) ভাষাগত উপাদান, (খ) জাতিগত উপাদান, (গ) ভৌগােলিক উপাদান, (ঘ) অর্থনৈতিক উপাদান।
(ক) তুলনামূলক শিক্ষার ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান : প্রাকৃতিক উপাদানসমূহের মধ্যে ভাষাও একটি বিষয় হিসাবে গণ্য হয়। একটি দেশ বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতীকের মধ্যে একটি হলাে, তার ব্যবহৃত ভাষা যা তাকে সেই দেশের জাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত করে। এই কারণে প্রায় সমস্ত জাতি সম্প্রদায়ের একটি নিজস্ব ভাষা আছে।
ভাষা একাধারে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের অঙ্গও বটে। সুতরাং কোনাে দেশের শিক্ষাপদ্ধতির ওপরে ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করতেই হবে। যে-সমস্ত দেশ নির্দেশাবলির মাধ্যম হিসাবে তাদের জাতীয় ভাষাকে গ্রহণ করছে তারা। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক দুর অগ্রসর হতে পেরেছে। অন্যদিকে যে-সমস্ত দেশ বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করেছে তারা নিজেদেরকে ততখানি উন্নত ক্ষেত্রে স্থাপন করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ ভারত ও জাপান রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা যায়। দীর্ঘকাল ধরে ভারতও ইংরেজির মতাে একটি বিশেষ ভাষা তথা বিদেশি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার্জনে প্রবৃত্ত থেকেছে। ফলত দেশের উন্নতি ঘটাতে দীর্ঘতর সময় অতিবাহিত হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের তুলনায় অনেক ছােটো দেশ জাপান সেখানকার শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করেছে ও প্রভূত উন্নতিলাভ করেছে। সুতরাং যেসমস্ত দেশে ভাষাগত সংখ্যা স্বল্পতা রয়েছে, সেখানে দেশের উন্নতি করতে চাইলে এই সংখ্যামান কমিয়ে জনসাধারণের শিক্ষা সমাধান করতে হবে। তুলনামূলক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন দেশের ভাষাসমস্যার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হই এবং এইসব সমস্যার সমাধানের সূত্র খুঁজে পাই। অর্থাৎ যেকোনাে শিক্ষারীতির ওপরেই ভাষার একটি বিশেষ প্রভাব আছে।
(খ) তুলনামূলক শিক্ষার জাতিগত উপাদান : জাতিগত উপাদান শিক্ষার বিকাশকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যেকোনাে দেশেই বিভিন্ন জাতি বাস করে। এইসব জাতিই সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। যে জাতি অন্য জাতির তুলনায় সর্বোত্তম সেই জাতি অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশ রচনা করেছিল এবং তারা আফ্রিকার অধিবাসীদের তুলনায় নিজেদের সর্বোত্তম মনে করত। কারণ তারা ছিল সাদা চামড়ার মানুষ। তারা একটি বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করে আফ্রিকার কালাে মানুষদের শাসন করত নিজেদের স্বার্থেই। একইভাবে ইংরেজরা ভারতবর্ষে তাদের শাসনকাঠামাে পরিচালনার উদ্দেশ্যে বিশেষ রীতির একটি শিক্ষাপ্রক্রিয়া চালু করেন। ব্রিটিশরা জাতিগতভাবে ছিল ভারতীয়দের তুলনায় বহুল উন্নত। তারা সুপরিকল্পিতভাবে ভারতীয়দের নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখত। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য তারা ইংরেজি ভাষাকে ভারতীয়দের মধ্যে বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। অধ্যাপক N, Hans-এর মতে, “Examples of racial and quasi-racial problem in education prove their complexity and the difficulty of finding a purely educational solution.”
(গ) তুলনামূলক শিক্ষার ভৌগােলিক উপাদান : যেকোনাে দেশের সংস্কৃতি,সভ্যতা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ভৌগােলিক অবস্থানের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভৌগােলিক অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং তাদের জীবনধারণের রীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক ও শিক্ষার পরিবেশও ভিন্ন। শীতের দেশের পরিবেশ যেমন নিরক্ষীয় অঞ্চলের পরিবেশের থেকে আলাদা ঠিক তেমনি বিভিন্ন দেশের জনসাধারণের পথ এবং তাদের সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক সংগঠনও পৃথক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে দেশ কৃষিনির্ভর তারা কৃষিভিত্তিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেয়। আবার যে দেশ শিল্পনির্ভর তারা শিল্প সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষার উপর জোর দেয়। শীতের দেশের বিদ্যালয়গুলিতে পঠনপাঠনের কথা মাথায় রেখে শীতকালীন ছুটি এবং গ্রীষ্মকালীন দেশে পঠনপাঠনের অসুবিধার কথা চিন্তা করে গ্রীষ্মকালীন ছুটির প্রচলন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, কোনাে দেশের শিক্ষাপ্রক্রিয়া তার ভৌগােলিক অবস্থার উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়।।
(ঘ) তুলনামূলক শিক্ষার অর্থনৈতিক উপাদান : যেকোনাে দেশের শিক্ষাপদ্ধতি তার অর্থনৈতিক অবস্থার উপর সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কযুক্ত। অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করেই ঐ দেশের শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম রচিত হয়। কারণ যেকোনাে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে দেশই সমস্ত সম্পত্তির মালিক। সুতরাং শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষায় শিশুদের দেশের সম্পত্তি বলেই বিবেচনা করা হয় এবং তাদের দেশের সম্পত্তি রক্ষা করার অঙ্গীকারবদ্ধ করার শিক্ষা দেওয়া হয়। যদিও আমেরিকা ও ভারতের মতাে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই নীতি একটু ভিন্ন। এই দুই দেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তিকেও স্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং এইসব দেশে সমাজের ধনী ও উচ্চবিত্ত লােকদের সন্তানদের জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় যেকোনাে দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে বা শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে। যেমন—রুশ বিপ্লব রাশিয়ার শিক্ষানীতির পরিবর্তনের কারণস্বরূপ।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।