রূপক অলংকার কাকে বলে | রূপক অলংকার কত প্রকার ও কি কি | উদাহরণসহ আলােচনা করাে
উত্তর:
বিষয়ের অপহ্নব না করে তার উপর বিষয়ীর অভেদ আরােপ করলে হয় রূপক অলংকার।
(সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বিষয় অর্থাৎ উপমেয়কে অস্বীকার না করে তার উপর বিষয়ী অর্থাৎ উপমান-এর অভেদ আরােপ করলে রূপক অলংকার হয়।)
আরােপ কথাটির অর্থ এক কথায় বােঝানাে অসম্ভব। ভাবটা এই একটি বস্তুর উপর অপর একটি বস্তুকে এমন ভাবে স্থাপন করা, যাতে দ্বিতীয়টি প্রথমটিকে নিজের রূপে রূপায়িত করে তােলে। এই অনুরঞ্জনের ফলে দুটি বিজাতীয় বস্তু এক বলে কল্পনা হয়। রূপক অলংকার তিন প্রকাবের – (ক) নিবঙ্গ রূপক (খ) সাঙ্গ রূপক (গ) পরম্পরিত রূপক। নিবঙ্গ রূপক আবার দুবকম – কেবল এবং মালা।
কেবল নিরঙ্গ রূপক
একটি বিষয় বা উপমেয়র উপর একটি বিষয়ী বা উপমানের আরােপ হলে হয় কেবল নিরঙ্গ রূপক। যেমন –
i) আত্মগ্লানির তুষানল আজ তাহাকে আর তেমন করিয়া দগ্ধ করিতেছিল না।
এখানে উপমেয়(বিষ্য): আত্মগ্লানি উসমান(বিষযী): তুষানল। দগ্ধ শব্দটি উপমানের অনুগামী – আত্মগ্লানি দগ্ধ করে না, দন্ধ করে তুষানল। তাই উপমান তুষানলই প্রাধান্য লাভ করেছে এবং উপমেয় আত্মগ্লানি-কে অস্বীকার না করে গৌণভাবে রেখে দিয়েছে। দগ্ধ কথাটি আমাদের মনকে সবলে আকর্ষণ করায়। আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে তুষানলে, আত্মগ্লানিতে নয়। দেখা যাচ্ছে, উপমান উপমেযকে গ্রাস করে ফেলে নি, কিনত্ত আচ্ছন্ন বা বহুলাংশে আপন রূপে রূপায়িত করেছে। অর্থাৎ আত্মগ্লানি তুষানলের রূপ ধরে দন্ধ করছে আর এই কারণেই রূপক অলংকার হয়েছে।
ii) লজ্জার বারিধিও আজ ততটা দুস্তর বলিয়া বােধ হইল না।
- এখানেও উপমান লজ্জা, উপমেয় বারিধির রূপ ধারণ করায় রূপক অলংকার হয়েছে।
iii) আসল কথাটা চাপা দিতে ভাই,
কাব্যের জাল বুনি।
- এখানেও উপমান আল উপমেয় কাব্যের রূপ ধারণ করায় রূপক অলংকার হযেছে।
এবং উপরােক্ত প্রত্যেকটি উদাহরণেই একটি উপমেযের উপর একটি উপমান আরােপ করা হয়েছে বলে প্রত্যেকটিই কেবল নিবঙ্গ রূপক অলংকার হয়েছে।
মালা রূপক
একটি বিষয়ের(উপমেয়) উপর বহু বিষযীর(উপমান) আরােপ হলে মালা রূপক হয়। যেমন – i) শীতের ওঢ়নী পিয়া গিরীষের বা
বরিষার ছত্র পিযা দরিয়ার না।
- এখানে বিষয় (উপমেয়)একটি – পিয়া, বিষযী চারটি- ওঢনী (ওড়না বা চাদর), বা (বাতাস), ছত্র (ছাতা), না (নৌকা)। অর্থাৎ উপমেয় পিয়া একাধিক উপমান যথাক্রমে ওড়না, বাতাস, ছাতা ও নৌকার রূপ ধারণ করেছে তাই মালা রূপক হযেছে।
ii) আমি কি তােমার উপদ্রব, অভিশাপ,
দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন, করলগ্ন কাঁটা?
এখানেও উপমেয় আমি, একাধিক উপমান যথাক্রমে উপদ্রব, অভিশাপ, দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপন, কাঁটার রূপ ধারণ করায় মালা রূপক হযেছে।
সাঙ্গ রূপক
অঙ্গসমেত অঙ্গী উপমেযের উপর অঙ্গসমেত অঙ্গী উপমানের অভেদ আরােপ হলে সাঙ্গ রূপক অলংকার হয়। যেমন –
i) কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে
আকাশের নীল গাঙে
হাবুডুবু খায় তারাবুদবুদ।
- এখানে অঙ্গী উপমেয় আকাশ, মেঘ ও তারা আকাশের অঙ্গ এবং অঙ্গী উপমান নীল গাঙ, মউজ(ঢেউ) ও বুদ্বুদ নীল গাঙের অঙ্গ।
ii) নন্দের নন্দন চাঁদ।
পাতিযে রূপের ফাঁদ
ব্যাধ ছিল কদম্বের তলে।
দিযে হাস্যসুধাচার
অঙ্গচ্ছটা আঠা তার।
- এখানে কৃঞকে ব্যাধ রূপে কল্পনা করে রূপক করা হয়েছে। অঙ্গী উপমেয় নন্দের নন্দন অর্থাৎ কৃঞ, তার অঙ্গ রূপ, হাস্য, অঙ্গচ্ছটা। অঙ্গী উসমান ব্যাধ, তার অঙ্গ ফাঁদ, চার ও আঠা। যেহেতু এগুলাে বাদ দিলে ব্যাধের চলে না। অঙ্গী ও অঙ্গ সর্বত্রই রূপক বলে এটি সাঙ্গ রূপকের উদাহরণ।
ii) শােকের ঝড় বহিল সভাতে;
শােভিল চৌদিকে সুরসুন্দরীর রূপে
বামাকুল; মুক্তকেশ মেঘমালা; ঘন
নিশ্বাস প্রবলবায়ু অশ্রুবারিধারা
আসার; জীমূতমন্দ্র হাহাকার রব!
- এখানে শােকের সঙ্গে ঝড়ের রূপক হযেছে। অর্থাৎ শােক ঝড়ের রূপ ধারণ করেছে। এবং অঙ্গী উপমেয় শােকের অঙ্গ হয়ে এসেছে বামাকুল, মুক্তকেশ, ঘননিশ্বাস, অশ্রুবারিধারা, হাহাকার রব তেমনি আবার অঙ্গী উসমান ঝড়-এর অঙ্গ হয়েছে সুরসুন্দরী(বিদ্যুৎ), মেঘমালা, প্রবলবায়ু, আসার(বর্ষণ), জীমূতমন্দ্র(মেঘগর্জন)।
iv) শঙ্খধবল আকাশগাঙে
শুভ্র মেঘের পালটি মেলে জ্যোৎস্নাতরী বেয়ে তুমি
ধবার ঘাটে কে আজ এলে?
- এখানে আকাশের সঙ্গে গাঙের(নদী) রূপক হযেছে। অঙ্গী উপমেয় আকাশের অঙ্গ হলাে মেঘ এবং জ্যোৎস্না। অঙ্গী উপমান গাঙ ও তার অঙ্গ হলাে পাল এবং তরী।
পরম্পরিত রূপক
যদি একটি উপমেযে উপমানের আরােপ অন্য উপমেযে তার উপমানের কারণ হয়, তবেই হয় পরম্পরিত রূপক।
(এই অলংকারে রূপকে রূপকে কার্যকারণভাবের পরম্পরা অর্থাৎ ধারা থাকে বলে। এর নাম পরম্পরিত। সাঙ্গ রূপকের মতাে অঙ্গের বা অঙ্গীর প্রশ্ন এখানে থাকে না। যেমন –
কেমনে বিদায় তােরে করি, বে বাছনি,
আঁধারি হৃদযাকাশ তুই পূর্ণশশী;
আমার!
এখানে তুই(ইন্দ্রজিত) – তে পূর্ণশশীর আরােপই হৃদয়ে আকাশারােপের কারণ। অর্থাৎ মা মন্দোদরীর কাছে পুত্র ইন্দ্রজিত পূর্ণশশী রূপ হওয়ার কারণেই তাঁর নিজের হৃদয় আকাশ রূপ লাভ করেছে, যার ফলে কার্যকারণের পরম্পরা লক্ষ করা যাচ্ছে। আর তাই এখানে পরম্পরিত রূপক অলংকার হয়েছে।
এখনাে যে দেহ রূপাের পাত বে,
হীরের টুকরাে আঁখি,
রণের শীত নিবারণ করে
বরফের কাঁথা ঢাকি!
এখানে হাটে বিক্রি করার জন্য আনা বরফ ঢাকা মাছের কথা বলা হয়েছে এবং মরণকে শীতের রূপক দান করার কারণেই বরফে কাঁথা-র রূপ আরােপ করা হযেছে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।