শুভ উৎসব – পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনা
প্রশ্ন : প্রদত্ত অনুচ্ছেদটিকে প্রস্তাবনা বা ভূমিকা স্বরূপ গ্রহণ করে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে, পরিণতিদানের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনা করো।
শুভ উৎসব
আমাদের উৎসবে এই অন্তরেরই প্রথম প্রতিষ্ঠা। সমারোহ সহকারে আমোদ- প্রমোদ করায় আমাদের উৎসবকলা কিছুমাত্র চরিতার্থ হয় না, কিন্তু তাহার মধ্যে সর্বজনের আন্তরিক প্রসন্নতা ও শুভ ইচ্ছাটুকু না থাকিলে নয়। উৎসবপ্রাঙ্গণ হইতে সামান্য ভিক্ষুকও যদি ম্লানমুখে ফিরিয়া যায়, শুভ উৎসব যেন একান্ত ক্ষুণ্ণ হয়। যাত্রা হউক, কথা হউক, রামায়ণগান হউক বা চণ্ডীপাঠ হউক, যখন যাহা হয়, উন্মুক্ত গৃহপ্রাঙ্গণে আসিয়া সর্বসাধারণে তাহাতে অকাতরে যোগদান করে, এবং সকলের সহিত একত্র হইয়া গৃহকর্তা তাহা উপভোগ করেন। [সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল]
উত্তর:
শুভ উৎসব
উৎসবপ্রিয় বাঙালি উৎসবকে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছে। সে উৎসবের ভিত্তিভূমিতে কখনও থাকে ঋতুর বৈচিত্র্য, কখনও সামাজিক অনুষ্ঠান, কখনও আবার ধর্ম বা অন্য কিছু। কিন্তু সব মিলিয়ে সব উৎসবই হল হৃদয়ের অকৃপণ আয়োজন, যা জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষকে কাছে টেনে নেয়। “আজ সবার রঙে রঙ মিলাতে হবে”–এটাই তো উৎসবের প্রাণকথা ।
বাঙালি বর্ষামঙ্গল গায়, বসন্তোৎসবে নাচে, নবান্নের আয়োজন করে- কোনোটাই তো তার ব্যক্তিগত নয়। সংঘশক্তির এক আনন্দময় প্রকাশই যেন এখানে উদ্ভাসিত হয় । বিবাহ বা অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে সকলে মিলেই তো আনন্দ ভাগ করে নেয়। জীবন উদযাপনে কোনো কৃপণতা অথবা কৃত্রিমতা বাঙালির ঐতিহ্যে নেই। একই কথা প্রযোজ্য ধর্মীয় উৎসবগুলির ক্ষেত্রেও। দুর্গাপুজো বা পরিত্র ঈদে কিংবা বড়োদিনে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। জাতিবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি শব্দগুলি যেন প্রাণের উচ্ছ্বাসে, উৎসবমুখরতায় অর্থহীন হয়ে যায়।
উৎসবের প্রধান ভাবনাই হল মঙ্গলচিন্তা। শুধু নিজের নয়, সকলের। জীবনযাপনের প্রতিদিনের তুচ্ছতা আর গ্লানিকে অতিক্রম করে উৎসব হল প্রাণের আমন্ত্রণ। আর্থিক সামর্থ্য যতই তুচ্ছ হোক, তাই দিয়েই অতিথি সৎকার করতে হবে। সে তো শুধু খাওয়াদাওয়া বা অনুষ্ঠান পালনই নয়, তার সঙ্গে জুড়ে থাকে আত্মার মিলন, শুভেচ্ছা জানানোর পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষা। মানুষের যে সামাজিক সত্তা, তারই জাগরণ ঘটে উৎসবের মধ্য দিয়ে। এমন বাঙালিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে অন্যের বাড়িতে কখনো নিমন্ত্রিত হননি বা নিজে অন্যকে নিমন্ত্রণ করেননি।
বাঙালির উৎসবপ্রিয়তাকে অনেকে হুজুগ বলে থাকেন, বলেন এ হল বিপুল টাকার শ্রাদ্ধ। কিন্তু এক-একটা উৎসবকে ঘিরে যে বিপুল টাকার লেনদেন হয়, তা বহু মানুষের জীবিকার্জনের পথও বটে। আর হুজুগ তো বাঙালির রক্তে। যে বাঙালি স্বদেশি আন্দোলনে মেতে উঠেছিল, আজও জীবনকে রাজনীতিময় করে রাখে, কিংবা যারা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলায় গ্যালারি ভরায়, রাত জেগে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের টিকিট কেনে—তাদের চারিত্রিক উন্মাদনা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না। কিন্তু তার আড়ালে থাকা প্রাণের সত্যকে এর জন্য কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। সে সত্য মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের সত্য, জীবনকে জীবন দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার সত্য।
মহাপুরুষদের বাণী যে আদর্শের কথা প্রচার করে, কিংবা পাঠ্যবইয়ে যে চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটে, তা-ই যেন মানুষ উপলব্ধি করে এই উৎসবের মধ্য দিয়ে। প্রতিদিনের জীবনের তুচ্ছতা আর সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে এই মিলনের মধ্য দিয়েই মানুষ মহৎ হয়ে ওঠে, প্রতিষ্ঠা পায় তার মানবত্ব। উৎসব দরিদ্রকে অন্ন দেয়, অবমানিতকে মর্যাদা দেয়, বিনি সুতোর মালায় গেঁথে ফেলে গোটা সমাজকে। মৈত্রী আর সম্ভাবনাকে আশ্রয় করে উৎসব এভাবেই এক সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।