প্রশ্নঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি আলোচনা করো ।
অথবা, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও বিষয়বস্তু আলোচনা কর ।
উত্তরঃ-
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি :
সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে বোঝায়, বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্র পরস্পরের কাছাকাছি এসেছে। আজকের দিনে একটি রাষ্ট্র যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতে পারে না। পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। এই নির্ভরশীলতার জন্যে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এমন কি সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আদান-প্রদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সম্পর্ক ও আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে যে শাস্ত্র গড়ে উঠেছে, তাকে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। অধ্যাপক হোলষ্টির (Holsti) ভাষায় বলা যায়, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা বিদেশ নীতির পর্যালোচনাকে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি :
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি কেমন, সে সম্পর্কে চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। অধ্যাপক মরগেনখাউ (Morgenthau) তাঁর লেখা Politics Among Nations গ্রন্থে বলেছেন, প্রকৃতির দিক থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলাটাই যুক্তিযুক্ত। কারণ রাজনীতি মানে হল ক্ষমতার লড়াই। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার লড়াই চলছে। তাঁর ভাষায়- International politics, like all politics, is struggle for power. শুনতে খারাপ লাগলেও এটি বাস্তব ঘটনা। কে কতটা ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং প্রভাব বিস্তার করবে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার লড়াই চলছে। এই লড়াইকে কেন্দ্ৰ করে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলাই ভাল। অধ্যাপক হফম্যান (Hoffmann) একই সুরে বলেছেন, -আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল মূলতঃ ক্ষমতার লড়াই-এর সম্পর্ক। এখানে নৈতিকতা যে নেই তা নয়। তবে ক্ষমতার দৌড়ে সবাই ব্যস্ত। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতির মধ্যে ক্ষমতার প্রশ্ন জড়িত আছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু :
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। বিশেষ করে বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। বহু নোতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। মারণাস্ত্রের ব্যাপক আবিষ্কার হয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট গড়ে উঠেছে। তাই অধ্যাপক কুইন্সি রাইট (Quincy Wright) বলেছেন,-এই সমস্ত কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচ্য বিষয় সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে এর পরিধি ও আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সবাই একমত নন। অধ্যাপক পামার ও পারকিন্স (Palmer & Perkins) এই শাস্ত্রের বিষয়বস্তু হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর কথা বলেছেন। অন্যদিকে মরগেনথাউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক তত্ত্বের কথা বলেছেন। আমরা বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু নিম্নলিখিতভাগে আলোচনা করতে পারি।
(ক) রাষ্ট্রগুলির ঘাত-প্রতিঘাতঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের দুটি দিক আছে, একটি হল সু-সম্পর্কের দিক, অন্যটি হল তিক্ততার দিক। এর ফলে একদিকে দেখা দেয় সহযোগিতা, অন্যদিকে বৈরিতা। একে বলে ঘাত-প্রতিঘাত (Inter-action)। এই ঘাত-প্রতিঘাত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু
(খ) সামরিক ও বেসামরিক সংস্থাঃ বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সামরিক জোট ও বেসরকারী সংস্থা ঢুকে পড়েছে। সামরিক জোটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল,-NATO জোট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এটি গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে অনেক বেসরকারী বহুজাতিক সংস্থা (MNC) আন্তর্জাতিক আঙিনায় প্রবেশ করেছে। তারা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীকে প্রভাবিত করেছে। ফলে এই সব জোট ও সংস্থা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(গ) মানুষের আচার-আচরণ: মানুষের আচার-আচরণ সমাজজীবনকে প্রভাবিত করে। তেমনি মানুষের আচার-আচরণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। যেমন, ইরাকে মার্কিন আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের জনসাধারণ যদি বিক্ষোভ দেখায়, তাহলে ভা ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে। তাই এইসব আচরণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু।
ঘ) তৃতীয় বিশ্ব: বিশ্বরাজনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব বিরাট পরিবর্তন এনেছে। প্রায় ১২৫টি দেশ এই গোষ্ঠীর মধ্যে আছে। বিশ্বে উত্তেজনা কমানোর ক্ষেত্রে এবং নোতুন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তাই এদের ভূমিকা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে।
ঙ) জাতীয় আন্দোলন: এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয় আন্দোলন এবং তাদের সঙ্গে বৃহৎ শক্তিবর্গের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া রাষ্ট্রসংঘের উপর কিভাবে পড়ছে বা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীকে কিভাবে প্রভাবিত করছে তা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনা করে।
(চ) বিশ্বজনমত: আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বজনমতের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সাম্রাজ্যবাদ অবসানের জন্যে জনগণের বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। এর প্রভাবকে অস্বীকার করা যাবে না। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখল করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ইরাকের মানুষ ও দুনিয়ার মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়ে তারা নীতি থেকে সরে এসেছে। শুধু তাই নয়, বিদেশ নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনমত বিশেষ ভূমিকা নিচ্ছে। তাই এই জনমত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু হয়েছে।
ছ) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান: মানবজাতি ও সভ্যতাকে যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচানোর প্রশ্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম বিষয়। আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ একটি বাস্তব ঘটনা। এই অভিশাপ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্যে জাতিসংঘ ও জাতিপুঞ্জ তৈরী হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা – আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু ।
মুল্যায়ন: অধ্যাপক বার্টন (Burton) বলেছেন, -আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি গতিশীল শাস্ত্র। এর পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি যদি কোন দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি অন্য দেশকে প্রভাবিত করে, তাহলে তাও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনার ক্ষেত্রে চলে আসছে।
Read Also
ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনার গুরুত্ব বা তাৎপর্য আলোচনা করো
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন | Non-Aligned Movement in Bengali
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।