এরিকসনের মনোসামাজিক তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো
উত্তর:
এরিকসনের মনোসামাজিক তত্ত্ব

মনােবিজ্ঞানী এরিকসনের মতে, সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ শিশুর বিকাশ ঘটে। বিকাশের প্রত্যেক স্তরে শিশু এক সমস্যামুলক জটিল পরিবেশের সম্মুখীন হয়। এরিকসন বিকাশের স্তরগুলিকে আটটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন, যেগুলির মনােসামাজিক সমস্যার সঙ্গে সংযােগ রয়েছে। নীচে মনােবিজ্ঞানী এরিকসনের মনােসামাজিক তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হল –
প্রথম স্তর — বিশ্বাস বনাম অবিশ্বাসের দ্বন্দু (0 – 1 বছর) : এই সময় একজন শিশু মাতা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল থাকে। যদি স্নেহপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়ে তার চাহিদা পূরণ হয় তবে পরিবারের প্রতি তার বিশ্বাস দৃঢ় হয় আর তা যদি না-হয় তাহলে তার মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয় এবং তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার মনােভাব তৈরি হয়।
দ্বিতীয় স্তরস্বাধীনতা বনাম লজ্জা ও সন্দেহের দ্বন্দু (1–3 বছর) : এই সময় শিশু শারীরিক ও সঞ্চালনমূলক দক্ষতা অর্জন করে। এবং তার মধ্যে স্বাধীনতাবােধের বিকাশ হয়। অন্যান্যদের সাহায্য ব্যতীত সে স্বাধীনভাবে সমস্ত কাজ করতে চায়। তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে যদি বাধা দেওয়া হয় তবে তার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং অন্যান্যদের উপস্থিতিতে সে লজ্জা অনুভব করে।
তৃতীয় স্তর – উদ্যোগ বনাম অপরাধপ্রবণতার দ্বন্দ (3–6 বছর) : এই স্তরে শিশুর দ্রুতগতিতে শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে। শিশু পরিবেশের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে কিন্তু এই উদ্যোগ গ্রহণ করার সময় যদি তাকে নিরুৎসাহ করা হয় তখন ওই শিশুর মধ্যে অপরাধবােধ জন্মায় এবং দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।
চতুর্থ স্তর — উৎপাদনশীলতা বনাম হীনম্মন্যতার দ্বন্দ্ব (6–11 বছর) : এই সময় শিশুদের মধ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ দক্ষতা জন্মায় এবং বিদ্যালয়ে বিভিন্ন কাজ করার প্রবণতা দেখা যায়। তারা ভীষণভাবে সক্রিয় থাকে এবং নতুন কোনাে উৎপাদনমূলক বা সৃষ্টিমূলক কাজ করতে চায় কিন্তু এক্ষেত্রে যদি কর্মসম্পাদনের ক্ষেত্রে তার কোনাে ত্রুটি হয় তবে তার মধ্যে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়।
পঞ্চম স্তর — আত্নপরিচয় বনাম ভূমিকা গ্রহণে অক্ষমতার দ্বন্দ (কৈশােরকাল) : এই স্তরে অনেক সময় কোনাে কিশােরের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি যথাযথভাবে হয়। তখন ওই কিশাের সমাজের ক্ষেত্রে তার নতুন ভূমিকা পালন করার জন্য অনুসন্ধান করতে থাকে। কিন্তু এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সে যদি ব্যর্থ হয় তখন এই দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। অর্থাৎ আত্মপরিচয় সম্বন্ধে দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয়।।
ষষ্ঠ সুর — ঘনিষ্ঠতা বনাম বিচ্ছিন্নতার দ্বন্দ্ব (নবীন প্রাপ্তবয়স্ক স্তর) : এই স্তরে ব্যক্তিরা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। কিন্তু কখনও যদি সে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয় তখন সে নিজেকে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় এবং তখনই এই দ্বন্দ্বের উৎপত্তি হয়।
সপ্তম স্তর — উৎপাদনৰনামথবিরতার দ্বন্দ(মধ্যবয়স্ক সুর) : এই স্তরে সে বৃত্তির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সে নিজেকে সৃষ্টিশীল, উৎপাদনমূলক ও সামাজিক কাজে নিয়ােজিত করে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়। তখন সে ব্যক্তিগতভাবে স্থবিরতায় পর্যবসিত হয়।
অষ্টম স্তর — সততা বনাম হতাশার দ্বন্দু (বৃদ্ধ বয়স): এই স্তরে ব্যক্তি যদি নিষ্ঠার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন, সততার সঙ্গে তার জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়, হতাশাকে জয় করতে পারে, জীবনের সংকটময় পরিস্থিতির সঙ্গে সাহসের সঙ্গে মােকাবিলা করে জীবনের অর্থ অনুধাবন করে সঠিক জীবনদর্শন গঠন করতে সক্ষম হয় তাদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয় না, অন্যথা এই দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়।
জীবনবিকাশের স্তর হিসেবে শৈশবকালের বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্য:
দৈহিক বিকাশ : জন্ম থেকে পাঁচ বছর এই শৈশবকাল বিস্তৃত। এই সময় শারীরিক বৃদ্ধি খুব দ্রুত ঘটে। সাধারণত জন্মের সময় শিশুর ওজন প্রায় 33 পাউন্ড এবং উচ্চতা 38 ইন্টি থাকে। পাঁচ বছর বয়সে তার ওজন প্রায় 43 পাউন্ড এবং উচ্চতাও 43 ইঞ্চি হয়। এ ছাড়া এই স্তরে স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ খুব দ্রুত হয় এবং শিশু বিভিন্ন প্রকারের সঞ্চালনমূলক দক্ষতা অর্জন করে।
ভাষাগত বিকাশ : একজন শিশুর ক্রন্দন থেকে ভাষার বিকাশ শুরু হয়। প্রথমদিকে এই ক্রন্দনের অর্থ স্পষ্টভাবে বােধগম্য হয় কিন্তু ছয় মাস বয়সে এই ক্রন্দন উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটে। ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত শিশু স্পষ্ট উচ্চারণ করে এবং দশ থেকে বারাে মাস বয়সে সে একটা কী দুটো অর্থপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করতে শেখে। মনােবিজ্ঞানী Smith শব্দসংখ্যা বিকাশের যে তালিকা নিরূপণ করেছেন তা নিম্নে দেওয়া হল
বয়স | শব্দের সংখ্যা |
1 বছর | 2 |
2 বছর | 270 |
3 বছর | 900 |
4 বছর | 1500 |
5 বছর | 2000 |
মানসিক বিকাশ : এই বিকাশের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হল কৌতুহলপ্রবণতা, জানার ইচ্ছা। শিশু এইসময়ে পরিবেশ সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। শিশুর মধ্যে শারীরিক এবং সামাজিক বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণা তৈরি হয়। অলৌকিকতা এই বিকাশের অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যেহেতু পূর্ববর্তী স্তরে ভাষার বিকাশ শুরু হয়েছে সেহেতু এই সময় চিন্তন ক্ষমতা ও যৌক্তিক ক্ষমতার বিকাশ শুরু হয়। এই সময় শিশুর মধ্যে রূপকথার গল্প শােনার প্রবণতা দেখা যায়।
প্রাক্ষোভিক বিকাশ : এই স্তরে শিশু মূলত প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রক্ষোভগুলি প্রাথমিক অবস্থায় থাকে এবং ঘন। ঘন পরিবর্তন হতে থাকে। উদাহরণের সাহায্যে বলা যায়, চার বছরের এক শিশু যদি খেলনা পাওয়ার জন্য ক্রন্দনের আশ্রয় নেয় তবে ওই শিশুই পাঁচ বছর বয়সে আর তা করে না, বরং প্রক্ষোভকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে।
সামাজিক বিকাশ : এই স্তরের প্রথমদিকে শিশুর মধ্যে সামাজিক আচরণ পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করতে করতে অন্যান্যদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে, কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক থাকে, তারপর বন্ধু নির্বাচন করে এবং এই স্তরের শেষের দিকে দলগত খেলায় অংশগ্রহণ করে। যেমন — লুকোচুরি, কানামাছি, কাবাডি ইত্যাদি।
যৌনজীবনের বিকাশ : এই স্তরে নিজের প্রতি ভালােবাসাকে কেন্দ্র করে যৌনতার বিকাশ হয়। একে বলা হয় Narcissism উপসংহারে বলা যায় শৈশবকালীন বিকাশমূলক বৈশিষ্ট্যগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। ভবিষ্যৎ জীবনের শিক্ষার ভিত্তি প্রস্তুতিতে এই বিকাশমূলক স্তরের অবদান অনস্বীকার্য।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।