প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা এখানে আমরা উচ্চমাধ্যমিক বাংলা থেকে জীবনচরিতের মূল সূত্র – পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনা নিয়ে আলোচনা করলাম। নীচে একটি অনুচ্ছেদ দেওয়া রয়েছে যেটা পড়ে তোমাকে জীবনচরিতের মূল সূত্র এর উপর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনা করতে বলা হয়েছে। আমরা নীচে তার সমাধান করে দিলাম।
জীবনচরিতের মূল সূত্র – পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রচনা
অনুচ্ছেদঃ কোনো ব্যক্তি-বিশেষের জীবনকথা লিখিয়া রাখিবার সাধ হয় কেন ? উত্তরে স্যার সিডনে লি বলিতেছেন যে, মানুষ চরিত্রের ও কীর্তির ধারা বজায় রাখিবার উদ্দেশ্যে, আগামীগণকে নিজেদের ভাবে ভাবুক রাখিবার উদ্দেশ্যেই ইতিহাস ও চরিতাখ্যান করিয়া থাকে। চিরজীবী হইয়া থাকিবার বাসনা মনুষ্য-হৃদয়ে বড়োই প্রবল। যদি পারিতাম, তবে স্বদেহকে চিরস্থায়ী করিয়া রাখিতাম। কিন্তু তাহা তো হইবার নহে। তাই মানুষ নিজের কীর্তির ও প্রভাবের ধারা বংশপরম্পরায় অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টায় ইতিহাস লেখে, চরিতাখ্যান করে, সমাধিমন্দির নির্মাণ করে, আলেখ্য ও বিগ্রহ রচিয়া থাকে। স্মৃতির সাহায্যে চরিত্রের ও কীর্তির পারম্পর্য রক্ষা করিবার জন্যই ইতিহাস ও জীবনাখ্যান লিখিত হয়। আবার মানুষেরও এমনই প্রকৃতি যে, মানুষ অতীত কথার আলোড়ন করিতে ভালোবাসে; পুরাতনকে সজীব রাখিবার জন্য মানুষ সাধ্যমতো চেষ্টা করে। ইহাই হইল চরিতাখ্যানের মূল তত্ত্ব।
উত্তর:
জীবনচরিতের মূল সূত্র
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে।” কিন্তু যে উন্নত ব্যক্তিত্ব ইতিহাস রচনা করেন, মানবসভ্যতার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর জীবনী তো চিরকালীন প্রেরণার উৎস। গৌতম বুদ্ধের শান্তির বার্তা প্রচার, মহাত্মা গান্ধির কৃচ্ছ্রসাধন, মাদার টেরিজার সেবাধর্ম—এসব তো মানবসমাজে অম্লান জ্যোতির মতো বিরাজ করছে। কালের সীমানা পেরিয়ে তাঁদের জীবনীই তো হতে পারে উজ্জীবনের মন্ত্র। চারপাশে যখন মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্বার্থপরতা আর হিংসার বিস্তার, তখন মহামানবরাই তো জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার পথ দেখাবেন। ইতিহাস তো কত মানুষের পদধ্বনি শুনেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিহাসের পথেই হারিয়ে গিয়েছেন, কেউ কেউ ইতিহাস হয়ে গেছেন নিজেরাই। এঁরাই আমাদের উপাস্য।
জীবনীসাহিত্যের বিষয় মহাজীবন। কিন্তু ইতিহাসখ্যাত মানুষদের আড়ালেও কিছু মানুষ থাকে যারা মহৎ জীবনের অধিকারী। এদের খুঁজে নেওয়াও জীবনীকারের কাজ। জীবনীসাহিত্য যেন পুজো না হয়, তা হবে জীবনের অন্বেষণ। ভালোমন্দ, আলো-অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সত্যের কাছে পৌঁছোনোর পথ দেখিয়ে দেবে জীবনীসাহিত্য। সেখানে থাকবে দেশ-কাল- সমাজে ব্যক্তির বিকাশের নিপুণ চিত্রকল্প
জীবনীসাহিত্যের ভাষা হবে জীবন্ত। ইতিহাসের গর্ব এবং মহিমাকে প্রাণবন্ত করে তুলতে হবে, ঘটনার ঘনঘটা যেন সেই ইতিহাসকে সজীব করে রাখতে পারে খেয়াল রাখতে হবে সেদিকেও। জীবনীসাহিত্য হল অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ। তা ভাবগত নয়, বস্তুগত। কোনো সমাধিমন্দিরের সঙ্গে এখানেই জীবনীসাহিত্যের পার্থক্য। ইতিহাস এখানে কথা বলে। চরিত্রগুলো যেন সামনে এসে দাঁড়ায়। আবার জীবনীসাহিত্য থেকেই পাঠক পান গল্প পড়ার আনন্দ। আসলে মহাজীবনের কাহিনি তো উপন্যাসের মতো। সেই মাধুর্য ও ব্যাপ্তি জীবনী-সাহিত্যে থাকা বাঞ্ছনীয়।
আত্মজীবনীও জীবনী। কিন্তু সেখানে থাকে ব্যক্তির নিজেকে জানানোর ইচ্ছা। এর ভালোমন্দ দু-দিকই আছে। জীবনের কোনো নিভৃত ঘটনা, যা একজন সাধারণ জীবনীকারের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তা জীবন্ত হয়ে ওঠে আত্মজীবনীতে। কিন্তু আত্মজীবনীতে থেকে যেতে পারে আত্মপ্রচারের প্রবণতা। ভিড় করতে পারে নানা অসম্ভব ও অবাস্তব ঘটনা, যা কল্পনার ফসল ছাড়া হয়তো অন্য কিছুই নয়। আবেগ এখানে বিশ্লেষণ অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবুও আত্মজীবনীর একটা নিজস্ব সুবাস আছে। দেবেন্দ্রনাথের ‘আত্মচরিত’, রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ এভাবেই আমাদের এক স্বপ্নমেদুর দুনিয়ায় নিয়ে যায়।
চৈতন্যদেবকে নিয়ে যে বাংলা জীবনীসাহিত্যের সূচনা তা আজ ফুলেফলে সমৃদ্ধ। নিজের বিষয়-বৈভব আর চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্যে বাংলা সাহিত্যে শুধু নয়, সার্বিকভাবেই জীবনীসাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে। শুধু তো ব্যক্তির চরিত্র গঠনে নয়, বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধি নিরাময়েও মহাপুরুষদের জীবনীগুলি পথ দেখাতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা এসব থেকে মুক্ত হয়ে মানবিক হওয়ার শিক্ষা-দীক্ষা আমরা জীবনীসাহিত্য থেকেই পেতে পারি। এই জীবনীসাহিত্যই আমাদের বিশ্বনাগরিক হওয়ার পথে এগিয়ে দেয়। তাই জীবনীসাহিত্য শুধু পাঠকের মনের খোরাক নয়, দেশ ও জাতির অগ্রগতির রসদও বটে।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।