পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প

ভূমিকা : পশ্চিমবঙ্গের হস্তশিল্প আজ সারাবিশ্বে সমাদৃত। কেননা বাঙালির মননে ও মানসিকতায় এক আশ্চর্য শিল্পসুষমা লুকিয়ে রয়েছে। তাই তার প্রতিটি কাজেই শিল্পীসত্তার প্রকাশ ঘটে। সে মাটি দিয়ে যে মূর্তি গড়ে, সুতাে দিয়ে যে কাপড় বােনে কিংবা অন্ধকার ঘরে বসে যে তৈজসপত্র বানায়—এ সবই কল্পনায়, নৈপুণ্যে এবং সৃষ্টিশীলতার আলােকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাংলার নগণ্য গ্রামের কোনাে এক ভাঙা কুঁড়েঘরে বসে, অজস্র অখ্যাত কারিগর তাদের হাতের সুক্ষ্ম মােচড়ে, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তােলেন কত আশ্চর্য শিল্পবস্তু। এই জাদুকরেরা মাটি দিয়ে গড়েন টেরাকোটা, সামান্য সুতাে দিয়ে জগদবিখ্যাত মসলিন, রেশম দিয়ে তসর, পেতলের তার দিয়ে ডােকরা কিংবা সামান্য মােষের শিং দিয়ে ঘর আলাে করা কোনাে অসামান্য পুতুল। বাংলার হস্তশিল্পের এই গৌরবময় ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের।

টেরাকোটা : রাজার হাতিশালে হাতি কিংবা ঘােড়াশালে ঘােড়া না-থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে এখন পােড়ামাটির হাতি-ঘােড়ার ছড়াছড়ি। বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া-বিষ্ণুপুরের পােড়ামাটির ঘােড়া বিশ্বের দরবারে সমাদৃত। মাটির সঙ্গে সামান্য বালি মিশিয়ে কুমােরের চাকিতে ঘুরিয়ে এই হাতি বা ঘােড়া তৈরি করা হয়। রােদে শুকনাে গাছের পাতার রং ব্যবহার করা হয় এদের গায়ে। এরপর আগুনের তাপে পুড়িয়ে তৈরি হয় এক অনবদ্য শিল্পকীর্তি। এটি টেরাকোটা নামে পরিচিত। বিশেষত মল্লরাজাদের আমলে তৈরি বিষ্ণুপুরের মন্দিরের টেরাকোটার কাজ পৃথিবীবিখ্যাত।

ডােকরা : ডােকরা শিল্পীদের দেখা যায় প্রধানত পূর্ব ভারতের কিছু  অঞ্চলে এবং পশ্চিমবাংলায়। এই কাজে খুব পরিশ্রম হলেও, দারিদ্র্যপীড়িত ডােকরা শিল্পীরা ঠিকমতাে পারিশ্রমিক পান না। বাঁকুড়ার বিকনা এবং বর্ধমানের গুসকরার দরিয়াপুর গ্রামের ডােকরার কাজ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই কাজে প্রথমে মােম দিয়ে হাতি-ঘােড়া কিংবা নানা দেবদেবীর মূর্তির ছাঁচ বা গহনা তৈরি করা হয়; সেখানে একটা ছিদ্র রাখা হয়। এরপর তার ওপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে সবশেষে ছিদ্র দিয়ে ঢেলে দেওয়া হয় গরম তরল পিতল। এইভাবে তৈরি হয় পিতলের মূর্তি।

কাঁথা : বাংলা দেশে নকশি কথা বলে একটি বিশেষ ধরনের সেলাই করা কাথা পাওয়া যায়। কবি জসিমউদ্দীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কবিতায় যা বিখ্যাত হয়ে আছে। বহু যুগ আগে আমাদের মা-ঠাকুরমার হাতেই এর জন্ম। শাড়ির পাড়ের সুতাে ছুঁচে পরিয়ে নানা লতাপাতায় কাথাটিকে সাজিয়ে তােলা হয়। ভারতীয় জাদুঘরে এবং গুরুসদয় মিউজিয়ামে এখনও প্রাচীন নকশি কাথার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। 

বাংলার অন্যান্য কুটিরশিল্প : কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল আজও তার গরিমা ও আভিজাত্য নিয়ে বাংলার মাটিতে বিরাজ করছে। আবার বীরভূমের ইলামবাজারের গালাশিল্প আজও আপন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল। এ ছাড়া শােলার কাজ প্রায় সারা পশ্চিমবঙ্গেই হয়ে থাকে। এই শােলার কাজ যারা করে তাদের বলা হয় মালাকার। বহরমপুরের কাসা-পিতল শিল্প বাংলার হস্তশিল্পের আর-এক উজ্জ্বল নিদর্শন। লােকনৃত্যের সঙ্গে জড়িত মুখােশও বাংলার হস্তশিল্পের অন্য একটি ঘরানা। বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির অনন্য ঐতিহ্যের প্রতীক।

উপসংহার : সংস্কৃতি বিলুপ্ত হলে সেই জাতিরই মৃত্যু ঘটে। তাই সরকার হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের বিভিন্ন অনুদান, সমবায় গঠন এবং মেলা বা হাটের নিয়মিত আয়ােজনের মাধ্যমে হস্তশিল্পীদের উৎসাহদানের চেষ্টা করছে। সরকারি স্তরে এদের সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। আশা করা যায় এইসব প্রচেষ্টা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতিকে সবল ও সুন্দর পথে চালিত করতে সদর্থক ভূমিকা পালন করবে।

আরো পড়ুন

তােমার প্রিয় লেখক – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের বিভিন্ন চরিত্র – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বইমেলা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভারতের জাতীয় সংহতি – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

আমাদের দেশ – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!