তােমার প্রিয় লেখক – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

তােমার প্রিয় লেখক

ভূমিকা : সেই কবে ১৮৬৪-তে গড় মান্দারণ থেকে অশ্বারােহণে বাংলা উপন্যাসের পথচলা শুরু হয়েছিল, সে চলা অন্তহীন পথে যাত্রা করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেদিন ভেরি বাজিয়েছিলেন। তারপর রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আরও অনেকেই সেই যাত্রাপথে অশ্বারােহী সৈনিকের সাথি হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ আমার পরিচিত, তাদের লেখা আমাকে আকর্ষণ করেছে। আবার অনেকেই থেকে গেছেন আমার জানাশােনার সীমানার বাইরে। তবু বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্করকে মনে রেখেও বলতে হয় সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সতীনাথ ভাদুড়ীই আমার প্রিয় লেখক।

শিক্ষা ও কর্মজীবন: ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর বিহারের পূর্ণিয়া জেলার ভাট্টাবাজারে সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্ম। ১৯৩০-এ এমএ পাশ করার পর আইনের ছাত্র হিসেবে ল পাস করে ওকালতি পেশায় যােগ দেন। তবে উত্তেজনামুখর সময়বৃত্তে দাঁড়িয়ে সতীনাথ নিজেকে জাতীয় আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪-এর মধ্যে একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।

সাহিত্যজীবন : সতীনাথ ভাদুড়ীর সাহিত্যজীবন ১৯৪৫ থেকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়পর্বে তার ৬টি উপন্যাস ও ৬টি ছােটোগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাসগুলি হল ‘জাগরী’ (১৯৪৫), চিত্রগুপ্তের ফাইল’ (১৯৪৯), “ঢোঁড়াইইচরিতমানস’ (১৯৪৯, ১৯৫১), অচিনরাগিণী (১৯৫৪), সংকট’ (১৯৫৭) এবং ‘দিগভ্রান্ত’ (১৯৬৫), গল্পগ্রন্থগুলি হল গণনায়ক’ (১৯৪৮), ‘অপরিচিতা’(১৯৫৪), চকাচকী’ (১৯৫৬), পত্রলেখার বাবা’ (১৯৫৯), “আলােক দৃষ্টি’ (১৯৬৪)।

উপন্যাস সাহিত্যে সতীনাথ : প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী তার ‘জাগরী’উপন্যাসের জন্য। এটি সতীনাথের প্রথম উপন্যাস এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক উপন্যাস। উপন্যাসটি ইউনেসকো থেকেও পুরস্কৃত হয়েছিল। বাবা-মা-বড়ােভাই বিলু ও ছােটোভাই নীলুর নিশিজাগরণের গল্প এখানে লেখক বলেছেন চারটি অধ্যায় জুড়ে। বাবা-মা ও বড়াে ভাই ৪২-এর ভারত ছাড়াে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে জেলবন্দি। ছােটোভাই নীলু ভিন্ন রাজনৈতিক মত পােষণ করে এই আন্দোলনে অংশ নেয়নি। ভােররাতে বিলুর ফাঁসি হবে। ছােটোভাই নীলুর সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই ফাঁসি। তবু সে তার দাদার দেহ নিতে এসেছে। অপেক্ষা করছে জেলফটকের সামনে। সমস্ত রাত চার জন মানুষই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। তবে একেবারে শেষ পাতায় পৌঁছে নীলু এবং আমরা পাঠক জানতে পারি সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ফাঁসির আদেশ রদ করেছে। এ এক অসাধারণ গল্প। উপন্যাসটিতে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বাধীন অসহযােগ আন্দোলনের ছোঁয়া রয়েছে।

কেন প্রিয়: সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি ছিলেন ‘Writer’s writer”। তিনি স্থানীয় লােকভাষা, লােকজীবন ব্যবহার করেছেন বলে সাধারণ পাঠকের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেই দূরত্বের মধ্যেই আমি খুঁজে পাই তার লেখক সত্তার স্বাতন্ত্র্য।

উপসংহার : বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে সমরেশ বসু—বাংলা কথাসাহিত্যের এই দীর্ঘ যাত্রাপথে পড়ে থাকা নুড়িপাথর আমি মাঝেমধ্যেই কুড়িয়ে নিই। কখনও ভালাে লাগে ‘আনন্দমঠ, কখনও পথের দাবী’, কখনও-বা ‘চার অধ্যায়। কিন্তু যেদিন প্রথম ‘জাগরী ’ পড়েছিলাম সেদিন যথার্থ অর্থেই চমকে উঠেছিলাম। একেবারেই অন্য ফর্মে, অন্য ধারায় অন্যভাবে লেখা একটি উপন্যাস, যেখানে জীবন আছে, জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনীতি আছে। আধুনিক বাংলার নতুন কথাকার সতীনাথ। সতীনাথ ভাদুড়ীই আমার প্রিয় লেখক।

আরো পড়ুন

তােমার প্রিয় কবি – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের বিভিন্ন চরিত্র – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বইমেলা – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

ভারতের জাতীয় সংহতি – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment