বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ (Realism)
যে মতবাদে বস্তুর জ্ঞান-নিরপেক্ষ বা মন-নিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় তাকে বস্তুবাদ বলে। কারো জানা বা না জানার উপর বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে না।
তাত্ত্বিক দিক থেকে বাস্তববাদ বলতে বোঝায় কোন একটি বিশেষ বস্তু বা বিষয়কে, যার মাধ্যমে ওই বিষয় বা বস্তুটির বস্তুগত দিক সম্পর্কে জানা যায় তাকে বাস্তববাদ বলে। বাস্তববাদ বস্তু জগতের ঘটনার সার্বিক এবং সত্যকে ভিত্তি করে গঠিত। বাস্তববাদীরা বলেন মনের বাইরে অবস্থিত বস্তু জগৎ, প্রকৃত জগৎ।
জড়জগৎ বা বস্তুজগৎ প্রাধান্য পায় বলে বাস্তববাদী দার্শনিকরা একদিকে জড়বাদী এবং অন্যদিকে বস্তুবাদী। বাস্তববাদীরা বলেন মানুষের মন বৃহৎ যান্ত্রিক জড় জগতের এক যান্ত্রিক ক্ষুদ্র অংশ। তারা মনে করেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই।
Ramthirth এর মতে – বাস্তববাদ হলো এমন একটি বিশ্বাস মূলক তত্ত্ব বা বিশ্বাস যেখানে বিশ্বের সমস্ত কিছু ঘটনা বা বিষয়কে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা হয়।
কৃত্রিম, স্থানুবৎ, অকার্যকরি, অতীতের ওপর নির্ভর না করে বাস্তববাদীরা বর্তমান ঘটনা প্রবাহ এবং জীবন অভিজ্ঞতার ওপর জোর দেন৷ এবং তারা মনে করেন কার্যকরী বর্তমানের উপর নির্ভর করেই মানুষ ভবিষ্যতের পথে সচল থাকবে।
বাস্তববাদী দার্শনিক :
জন লক, হারবার্ট স্পেনসার, রাসেল, জন মিলটন, ডেকারতে, ইরাসমাস, রাবেলায়িস, মন্টেগু, কমেনিয়াস, মুলকাসটার, মনটেইন
বাস্তববাদের প্রকারভেদ :
বাস্তববাদ তিন ধরনের –
1. মানবিক বাস্তববাদ: মানবিক বাস্তববাদের মূল লক্ষ্য হলো মানবজীবন। প্রকৃতি এবং সমাজ সম্বন্ধে জ্ঞান
অর্জন করা।
2. সামাজিক বাস্তববাদ: সমস্ত সুখের মূল উৎস হলো নৈতিক উৎকর্ষ বা পুণ্য অর্জন। এই শিক্ষার মূল মন্ত্ৰ ছিল প্রকৃত জীবনশৈলী (Art of Living) গড়ে তুলতে শেখানো।
3. সংবেদনভিত্তিক বাস্তববাদ: এই দর্শন ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বলা হয়েছে আমাদের ইন্দ্রগুলো বাইরের জ্ঞানজগতের জানলা। তাই সেগুলো সুস্থ রাখা দরকার, এবং পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করতে শেখানো দরকার।
বাস্তববাদের বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি (Principle of Realism) :
1. বাস্তব জগৎ একমাত্র সত্য।
2. বস্তুবাদ ভাববাদের বিপরীত মতাদর্শ। অর্থাৎ বস্তুবাদিরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না ।
3. সমস্ত বিষয় সত্য। অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের জানা বা না জানার উপর নির্ভর করে না।
4. সংবেদন হল জ্ঞান অর্জনের প্রধান চাবিকাঠি।
5. মানুষ হলো বস্তু জগতের একটি অংশ মাত্র।
6. পরীক্ষা নিরীক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য (Realism and Aims of Education) :
- এই মত অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিশুকে সুখী ও স্বাস্থ্যজ্জ্বল জীবনে প্রতিষ্ঠা করা।
- শিক্ষার্থীদের দৈহিক এবং মানসিক ক্ষমতার বিকাশে সাহায্য করা।
- এই মত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বিকাশ ধারায় সংবেদন গঠনে প্রশিক্ষণ দান করা।
- শিশুকে বাস্তব জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা ও বিভিন্ন বাহ্যিক বস্তুর সহিত শিশুর পরিচিতি লাভ করানো।
- শিক্ষার্থীদের প্রকৃতি এবং সামাজিক পরিবেশ অনুযায়ী জ্ঞান সরবরাহের সহযোগিতা করা
- এই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের বৃত্তিগত শিক্ষার ব্যবস্থা করা
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ ও শিক্ষার পাঠক্রম (Realism & Curriculum) :
- সার্বিক মানুষ গড়ে তোলার জন্য পাঠ্যক্রমে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজন আছে এরকম বহুবিধ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
- বাস্তববাদীরা পাঠ্যক্রমে বাস্তবে কার্যকরী বিজ্ঞান, বৃত্তিমূলক বিষয়পাঠকে সার্বিক গুরুত্ব দিয়েছে। স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য শারীরিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা, এর সঙ্গে গণিত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ভূগোল, ইতিহাস, আইন ও গুরুত্ব পায়। এবং বলা হয় শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষী।
- বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ দার্শনিক মতবাদ অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে শিক্ষা পাঠক্রম রচনা করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে শিশু বাহ্যিক জগতের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারে।
- বস্তুবাদী শিক্ষাদর্শনের পাঠক্রমের মূল ভিত্তি হবে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে।
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ ও শিক্ষাদান পদ্ধতি (Realism & Teaching Method):
বস্তুবাদী মতাদর্শে সকল জ্ঞানের প্রবেশদ্বার হল ইন্দ্রিয়। এই কারনে বস্তুবাদী দার্শনিকগণ পুঁথিগত জ্ঞানার্জনের প্রতি সম্পূর্ণ বিরোধী। এই মতামত অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জন করবে বাহ্যিক জগতের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। শিক্ষার পদ্ধতি হিসেবে লেকচার পদ্ধতি, আলোচনা পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট বস্তুবাদী দার্শনিক মিলটন শিশুদের শিথন -এর ক্ষেত্রে ভ্রমণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এছাড়াও –
* Inductive বা আরোহী পদ্ধতির মাধ্যমে,
* Correlation সমন্বয়ী পদ্ধতিতে
* পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ পদ্ধতির দ্বারা,
* Teaching by using audio-visual aids,
* ‘সহজ থেকে জটিল, ‘মুর্ত থেকে বিমুৰ্ততে’ শিক্ষাদান,
* শিক্ষায় পুনরাবৃত্তির উপর জোর দেওয়া,
* সহশিক্ষামূলক কার্যকলাপ,
* প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষাদান
* এইসব শিক্ষাদান পদ্ধতির কথা বাস্তববাদ দর্শনে বলা হয়েছে।
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ ও শিক্ষক (Realism and Teacher) :
জগৎ ও জীবনের সকল ঘটনা ও সমস্যাগুলিকে তিনি বিদ্যার্থীর সামনে তুলে ধরবেন। এর ফলে বিদ্যাৰ্থী তার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলকে চিনতে শিখবে। শিক্ষকের ভূমিকা শুধু পথ-প্রদর্শকের। জীবনের কঠোর বাস্তবকে জানার জন্য একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে পথ দেখাবেন। প্রকৃত শিক্ষক হবেন এমন একজন ব্যক্তি যার পথ অনুসরণ করে শিক্ষার্থী বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে জগৎ প্রত্যক্ষ করবে, জাগতিক ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করবে এবং জীবনের যেকোন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে সমর্থ হবে।
বাস্তববাদ ও শৃঙ্খলা :
বাস্তববাদীরা শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এরা মনে করেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্ধারিত নিয়মকানুন কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে। তবে বাস্তববাদীরা শৃঙ্খলা রক্ষার্থে শাস্তিদান প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী নন। তারা চান শিক্ষার্থীদের উন্নত পরিবেশ সরবরাহ করার পর তারা নিয়মনীতি মান্য করে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই শৃঙ্খলিত হোক।
Read Also
মানবতাবাদ | Humanism in Bengali
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।