ভারতে ইসলামীয় শিক্ষাব্যাবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলি লেখো

ভারতে ইসলামীয় শিক্ষাব্যাবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলি লেখো
অথবা, ভারতে মধ্যযুগীয় শিক্ষার উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে

উত্তর:

ভারতে ইসলামীয় শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য :

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সময়কালকে ভারতীয় ইতিহাসে মধ্যযুগ বা ইসলামীয় যুগ নামে অভিহিত করা হয়। এই সময়কালে ভারতবর্ষে মুসলমান সম্রাটরা রাজত্ব করেছেন। ফলে ওই সময়কালে ভারতীয় শিক্ষায় ইসলামিক জীবনাদর্শের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে। ওই যুগের শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে সংক্ষেপে আলােচনা করা হল — 

এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীর

(1) শিক্ষার লক্ষ্যনৈতিক ও জাগতিক জীবনের মানােন্নয়নে সহায়তা করা। কোরান ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে নির্দিষ্ট রীতিনীতি মেনে চলার উপযােগী মানসিকতা গড়ে তােলা। জ্ঞানই ঈশ্বরের কাছে পৌছােতে সাহায্য করে—এই সত্যেই বিশ্বাসী ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। এ ছাড়া নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিক শিক্ষা ছিল ইসলামিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। পবিত্র কোরানের নির্দেশ অনুযায়ী চরিত্রবান ও ধার্মিক মানুষ সৃষ্টিই ছিল এই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। মধ্যযুগের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালােচনার মধ্য দিয়ে বলা যায় টোলের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল পণ্ডিত তৈরি করা ও মাদ্রাসা শিক্ষার লক্ষ্য ছিল মৌলবি তৈরি করা।
(2) সংগঠনইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাসংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য হল প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মক্তব এবং উচ্চশিক্ষারজন্য মাদ্রাসা।
(3) পাঠক্রমধর্মচর্চাই ছিল মুসলিম শিক্ষার মূল বিষয়। সেইকারণে মক্তবে ‘নমাজ’ ও ‘ফতিয়া’ বা ‘তর্পণ’ শেখানাে হত। শুধু উচ্চারণ ও মুখস্থ করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। মক্তবের প্রাথমিক পর্যায়ে কথােপকথনের কৌশল, পত্রলিখন এবং গণিত শেখানাে হত। আর মক্তবের উচ্চপর্যায়ে পির-পয়গম্বরের জীবনী, ফরাসি কাব্যগাথা ইত্যাদিও পাঠ্য ছিল। অন্যদিকে মাদ্রাসার উচ্চশিক্ষায় দু-ধরনের পাঠক্রম চালু ছিল। ধর্মীয় পাঠক্রমে কোরান পাঠ, কোরানের ব্যাখ্যা, পয়গম্বর হজরত মহম্মদের বাণী, ইসলামিক আইন, হাদিস ও ব্যাখ্যা, সুফি মতবাদ ইত্যাদি সবিস্তারে আলােচনার ব্যবস্থা ছিল। এ ছাড়া, ধর্মনিরপেক্ষ পাঠক্রমে আরবি, ব্যাকরণ, গদ্য, সাহিত্য, তর্কবিদ্যা, দর্শন, আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভূগােল, কৃষিবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। শিক্ষার মাধ্যম ছিল আরবি ও ফারসি ভাষা। 
(4) পৃষ্ঠপােষকতাইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা ছিল অবৈতনিক।মুসলিম শাসকগণ মক্তব ও মাদ্রাসার যাবতীয় খরচ বহন করতেন। অনেক ক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দেওয়া হত। 
(5) শৃঙ্খলাইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় অধিকাংশ সময়ইশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা লেগে থাকত। শিক্ষার্থীদেরকে দৈহিক শাস্তিও দেওয়া হত। কানমলা, বেত্রাঘাত ইত্যাদি শাস্তির ব্যবস্থা দেখাযেত।
(6) শিক্ষক-শিক্ষার্থী সুসম্পর্কইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষক সম্পর্ক এবং শিক্ষার্থী আবাসিক হিসেবে বসবাস করতেন। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠত। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে সম্মান করত এবং শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে পুত্রের মতাে করে স্নেহকরতেন।
(7) শিক্ষার মাধ্যমইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষাকে অবহেলা|করা হত। শিক্ষার মাধ্যম ছিল ফারসি ও আরবি ভাষা।
(8) নারীশিক্ষাইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় নারীশিক্ষা অনেকটাইঅবহেলিত ছিল। একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়েরা একসাথে মক্তবে পড়লেও সাত বছর বয়সের পর মেয়েদের আর মক্তবে আসতে দেওয়া হত না। অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়েরাবাড়িতে বসে শিক্ষাগ্রহণ করত।
(9) শিক্ষার সুযােগইসলামিক যুগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার খুবই অভাব| ছিল। হিন্দু শিক্ষার্থীরা খুব একটা শিক্ষার সুযােগপেত না। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মুসলমানরাইশিক্ষার সুযােগ লাভ করত। 
(10) মূল্যায়নইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমান কালের মতােপরীক্ষাপদ্ধতি ছিল না। তবে ক্রমিক মূল্যায়নেরপ্রথা চালু ছিল।
(11) সামরিক  শিক্ষাইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সামরিক শিক্ষাশিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। হিন্দুরাজাদের ওপর প্রভুত্ব বা কর্তৃত্ব চালানাের জন্য বিভিন্ন প্রকারসামরিক কৌশল শিক্ষার্থীদের শেখানাে হত।
(12) ডিগ্রি বা উপাধি দানইসলামিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা শেষে উপাধি দান। শিক্ষার্থীদেরকে ডিগ্রি বা উপাধি প্রদান করা হত।ধর্মতত্ত্বে পারদর্শিতার জন্য ‘আলিম’, যুক্তিতর্কে বা আইনে পারদর্শিতার জন্য ‘ফাজিল’ এবং সাহিত্যে দক্ষতা অর্জনের জন্য ‘কাবিল’ উপাধি প্রদান করা হত।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment