বিকাশ কাকে বলে | বিকাশের ধারণা | বিকাশের বৈশিষ্ট্য

বিকাশ কাকে বলে | বিকাশের ধারণা | বিকাশের বৈশিষ্ট্য
অথবা, বিকাশের সংজ্ঞা দাও | বিকাশের বৈশিষ্ট্য ও নীতি উল্লেখ করাে

উত্তর : 

বিকাশ কাকে বলে : 

ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সার্বিক, উন্নয়নমূলক ও ক্রিয়াগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়াই হল বিকাশ, যা গুণগত দিক থেকে বিচারবিবেচনার যােগ্য।

বিকাশের ধারণা : 

শিক্ষা-মনােবিজ্ঞানে বিকাশের ধারণা খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। শিশুর শৈশব অবস্থা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক স্তর পর্যন্ত যে বিকাশ, তা সীমাবদ্ধ নয়। ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বিকাশ প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে। বিকাশ হল এক ক্রমপরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া যা শারীরিক পরিবর্তন অতিক্রম করে ক্রিয়াগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় শর্ত হিসেবে উপস্থিত হয়। বিকাশের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি এক অত্যাবশ্যক শর্ত, কিন্তু বৃদ্ধি ও বিকাশ এক নয়। উদাহরণের সাহায্যে বলা যেতে পারে, কোনাে মানুষের হাতের একটা আঙুল যদি না-থাকে তাহলে তার হাতের বৃদ্ধি হলেও বেশ কিছু কাজ করার ক্ষেত্রে সে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে না অর্থাৎ, তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। বিকাশ মানুষকে নির্ভুল কর্মসম্পাদনে সাহায্য করে। একজন ব্যক্তির আদর্শ, মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি যৌক্তিক ক্ষমতা গঠনে ও সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানে সাহায্য করে। জগতের প্রতিটি কার্যের কারণ অনুসন্ধান ও ফলাফল বিশ্লেষণে সাহায্য করে বিকাশ। তাই বিকাশ প্রক্রিয়া হল সর্বজনীন ও সামগ্রিক। তবে বিকাশ শুধুমাত্র গুণগত পরিবর্তন নয় পরিমাণগত পরিবর্তনও বটে। 

বিকাশের বৈশিষ্ট্য : 

বিকাশ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে আলােচিত হল— 

[1] বিকাশ প্রক্রিয়ার পরিধি সমগ্র জীবনে পরিব্যাপ্ত থাকে : জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিকাশ প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে। অর্থাৎ, জীবনের সমগ্র ক্ষেত্রে বিকাশ উন্নত থেকে উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত হতে থাকে। তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা এমন কর্মসূচি গ্রহণ করবেন যার জন্য বিকাশ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে ও ভবিষ্যৎ জীবনে সঞ্চালিত হবে। যেমন—বিভিন্ন মনীষীদের জীবনীপাঠের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক উন্নত মতাদর্শ গড়ে তােলা। 

[2] বিকাশ হল ক্রিয়াগত পরিবর্তন : বিকাশ প্রক্রিয়া মানবশিশুর ক্রিয়াগত পরিবর্তনে সহায়ক। বিকাশ মানুষকে জটিল থেকে জটিলতর কর্মসম্পাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যেমন—কোনাে শিশু দশ মাস বয়সে হামাগুড়ি দেওয়ার পর 14–15 মাস বয়সে কোনাে কিছুকে অবলম্বন করে এক একটা পা-এর ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ বিকাশ হল ক্ৰম-উন্নয়নশীল ক্রিয়াগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। বিদ্যালয়ে পাঠক্রম নির্ধারণের সময় ক্রিয়াগত পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার। 

[3] বিকাশ হল ব্যক্তির সহজাত দৈহিক-মানসিক ক্ষমতা বা সামর্থ্যের প্রকাশ : বিকাশ হল এক সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ যা দৈহিক ও মানসিক উভয়ই। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন দৈহিক উন্নতি হয় তেমনি মানসিক দিক থেকেও অগ্রগতি ঘটে। উদাহরণের সাহায্যে বলা যায়, একটি শিশু যেমন—দৈহিক বিকাশের মাধ্যমে দুটো আঙুলের ফাকে পেনসিল ধরে ছবি আঁকতে শেখে ঠিক তেমনি মানসিক বিকাশের মাধ্যমে তার কল্পনাশক্তিরও একইভাবে বিকাশ ঘটে। তাই বিদ্যালয়ে বিভিন্ন দৈহিক খেলাধুলা, ছবি আঁকা, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, গল্প বলা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিযােগিতার আয়ােজন করা খুবই প্রাসঙ্গিক দৈহিক-মানসিক সামর্থ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে। 

[4] বিকাশ এক নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া: মাতৃগর্ভ থেকে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বিকাশ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে এবং এর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। যেমন, শিশু ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে শব্দ গঠন করতে শেখে বা শব্দ বলতে শেখে। তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকা। শিক্ষার্থীর এই বিকাশমূলক ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ করে পাঠ্যবিষয় নির্ধারণ করবেন। 

[5] শিখনের  সঙ্গে বিকাশ নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ : শিখন হল এক প্রকারের সমস্যা সমাধান। অর্থাৎ এই সমাধান হল আচরণের পরিবর্তন। যে-কোনাে পরিবেশে আচরণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবেশে সংগতিবিধান করাই হল শিখন এবং পরিবেশের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে শিশু যে শিখন অভিজ্ঞতা অর্জন করে তারই সমন্বিত রূপ হল বিকাশ। মনােবিদ Bayer-এর মতে, আচরণের পরিবর্তন বা শিখনের ফলে বিকাশ ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুদের শিক্ষাপরিকল্পনা রচনাকালে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে যে বিষয়গুলি অধ্যয়ন করা হয় তার মধ্য দিয়ে শিশুর বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। যেমন—দ্বিতীয় শ্রেণিতে সহজ পদ্ধতিতে যােগ, বিয়ােগ, গুণ, ভাগ শেখার ফলে তৃতীয় শ্রেণিতে সহজ পদ্ধতিতে সরল করতে সক্ষম হয়। এখানে শিখনই বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে। 

[6] বিকাশ এক সংশ্লেষণমূলক প্রক্রিয়া : বিকাশ মানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককের সমষ্টি নয়, এক সমন্বিত প্রক্রিয়া। প্রজ্ঞাবাদী মনােবিদগণ বিকাশকে এক সামগ্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অর্থাৎ তাদের মতে, দৈহিক, মানসিক, বৌদ্ধিক, প্রাক্ষোভিক ও সামাজিক বিকাশগুলি বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে না, এককভাবে সম্পন্ন হয়। তাই বিকাশের এই বৈশিষ্ট্যের কথা চিন্তা করে বিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিকাশ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। 

[7] বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পার্থক্য বিদ্যমান : বিকাশ হল ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া। ব্যক্তিবিশেষে বিকাশের ক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। এবং শুধু তাই নয় বিভিন্ন বয়সে বিকাশের হারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সেজন্য বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্যকে পরিপুষ্ট করা যেতে পারে। যেমন—প্রজেক্টর, বিভিন্ন স্লাইড, Teaching machine ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত চাহিদা ও আগ্রহ অনুযায়ী শিক্ষা অর্জনে সক্ষম হবে। অপরদিকে, বিকাশ প্রক্রিয়াও যথাযথভাবে সম্পন্ন হবে। 

[8] বিকাশ প্রক্রিয়া সমগ্র থেকে বিশেষে সঞ্চালিত হয় : ধারাবাহিকতার এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল সমগ্র থেকে বিশেষে ধাবিত হওয়া। বিকাশ প্রক্রিয়াও এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং এটিও শুরু হয় সামগ্রিকভাবে পরে বিশেষভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেমন, শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেছে, প্রথম অক্ষর লেখার সময় হাতের প্রত্যেকটি আঙুল পেনসিল ধরার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে, পরবর্তীকালে শুধুমাত্র তিনটি আঙুল ব্যবহার করতে শেখে। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ্য যে, শিশুদের কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ উপলদ্ধি করানাের সময় প্রথমে সমগ্র কবিতাটি মুখস্থ করানােই সমীচীন, তারপর প্রতিটি শব্দের অর্থ ও পক্তিগুলির ব্যাখ্যাকরণ যুক্তিযুক্ত। 

[9] বিকাশের ক্ষেত্রে লিঙগত প্রভেদ বিদ্যমান : স্ত্রী-পুরুষের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভেদ রয়েছে। এক্ষেত্রে লক্ষ করা গেছে, বালিকাদের বিকাশ বালকদের পূর্বে হয়। এজন্য বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে মেয়েদের জন্য কিছু পৃথক বিষয় সংযােজন করা অত্যাবশ্যক। যেমন—যৌন শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা সম্পর্কিত কিছু পৃথক পাঠ্যবিষয় পৃথকভাবে নারীদের পাঠক্রমে সংযােজন করা গেলে নারী এবং পুরুষ উভয়েরই বিকাশ যথােচিতভাবে সুসম্পন্ন হবে। উপরােক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জীবন ও বিকাশ প্রায় সমার্থক। মানবজীবন যতদিন ধরে অতিবাহিত হয় বিকাশ প্রক্রিয়াও ততদিন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে। শুধু তাই নয়, জীবনের প্রত্যেক স্তরের সঙ্গে বিকাশের এক অনন্য সামঞ্জস্য আছে। তাই জীবনের তাৎপর্য বাস্তবায়িত করতে হলে মানবশিশুর বিকাশকে সঠিকপথে পরিচালিত করা আমাদের প্রত্যেকের একান্ত কর্তব্য।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment