ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্য গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্য গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো

উত্তর : 

ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্য : 

আনুমানিক 2000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 300 খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল হল বৈদিক শিক্ষার যুগ। আলােচনার সুবিধার জন্য ওই যুগকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। যথা—ঋগবেদের যুগ, পরবর্তী বেদের যুগ এবং সূত্র সাহিত্যের যুগ। পরবর্তী বেদের যুগে স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থায় সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার যুগকেই বলা হত ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার যুগ। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা হল আদি বৈদিক শিক্ষার উন্নত রূপ। ওই শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকগুলি লক্ষ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। বিশিষ্ট গবেষক এ এম আলটেকার ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার যেসকল লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেছেন, তা এখানে সংক্ষেপে আলােচনা করা হল — 

[1] আত্মোপলদ্ধি ও মােক্ষলাভ : আত্মােপলব্ধি ও পুনর্জন্ম থেকে মুক্তিই ছিল ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার মূল লক্ষ্য। মানুষের মধ্যে পূর্ণতা বিরাজ করে। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্য সেই পূর্ণতার বিকাশ সাধনের দ্বারা শিক্ষার্থীকে পূর্ণজ্ঞান, পূর্ণশক্তি লাভে সাহায্য করা। এককথায় জীবনের পূর্ণ আনন্দকে প্রস্ফুটিত করা। 

[2] ব্যক্তির মধ্যে ধর্মবােধের ভিত্তিস্থাপন : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার অপর একটি লক্ষ্য ছিল শিক্ষারুপ সাধনার মধ্য দিয়ে ধর্মের উদ্দেশ্যসাধনের পাশাপাশি পরমব্রহ্মকে সঠিকভাবে উপলদ্ধি করা, পরমব্রহ্মের সঙ্গে ভক্তিভাবের সম্পর্ক স্থাপন করা এবং জ্ঞান, অনুভব ও প্রবৃত্তির দিক থেকে আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষের মাধ্যমে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের পরমসত্তাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করা। 

[3] চরিত্রগঠনে সহায়তা : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থার অপর একটি লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থী বা শিষ্যের চরিত্র গঠন করা। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় গুরু কেবল পাঠদানই করতেন না, শিক্ষার্থীর চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশের জন্যও সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, ধৈর্য, সদাচার, সুঅভ্যাস গঠন ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষার্থীদেরকে অবহিত করা হত। আশ্রমের বিভিন্ন কার্যাবলি এমনভাবে পরিচালনা করা হত যে, সেইসব কার্যাবলি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুঅভ্যাস, সদাচার, সত্যবাদিতা প্রভৃতি গুণের বিকাশ ঘটত।

[4] ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুগৃহের বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস, আত্মসংযম, আত্মসম্মানবােধ প্রভৃতি গুণের বিকাশ ঘটানাে হত। মুলকথা হল শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশে সহায়তা করাই ছিল ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। 

[5] সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চর্চা, সংরক্ষণ ও সঞ্চালন : ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুশীলন, সংরক্ষণ ও সঞ্চালন করা। গুরুগৃহে বেদচর্চা, বেদ অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক ছিল। শুধু বেদ অধ্যয়ন বা চর্চা নয়, বেদ কণ্ঠস্থ করে, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালিত করাও ছিল এই শিক্ষার অন্য একটি লক্ষ্য। 

[6] নান্দনিকতার বিকাশ সাধন : ব্রাম্মণ্য শিক্ষার সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল বিভিন্ন ধরনের পূজার্চনা ও যজ্ঞের অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানের জন্য শিষ্যদের কাজ ছিল সুন্দরভাবে আলপনা দিয়ে পূজার বেদি, পূজা ও যজ্ঞের স্থান সজ্জিত করা। ওই আলপনাদান ও যজ্ঞস্থান সাজানাের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নান্দনিকতার বিকাশ ঘটত। তাই অনেক শিক্ষাবিদ মনে করেন, ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার একটি লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যবােধের বিকাশ ঘটানাে।

[7] সামাজিক ও সাংসারিক দায়িত্ব পালনের অনুশীলন : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে প্রায় বারাে বছর ধরে গুরুগৃহের প্রতিটি কাজ নিজের হাতে করতে হত। গােপালন থেকে শুরু করে, আশ্রম বা গুরুগৃহ পরিষ্কার করা, গুরুর পরিবারের জন্য ভিক্ষা করা, পূজার উপকরণ সংগ্রহ করা ইত্যাদি এইসব কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর সামাজিক ও সাংসারিক জীবনের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হত। তাই অনেকে ‘সামাজিক ও সাংসারিক দায়িত্ব পালনের অনুশীলন’-কে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার একটি লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন। 

[8] বর্ণ অনুযায়ী পেশাগত শিক্ষাদান : ব্রাহ্মণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় দু-ধরনের পাঠক্রমের অনুশীলন লক্ষ করা যায়— পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা। জগতে বেঁচে থাকার জন্য পরাবিদ্যার জ্ঞান খুব একটা কাজে লাগত না, তাই পরাবিদ্যার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য অপরাবিদ্যা অনুশীলনেরও ব্যবস্থা ছিল। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার চরম লক্ষ্য আত্মার মুক্তি হলেও, অধিকাংশ শিক্ষার্থী ব্ৰষ্মচারী থেকে গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করত। তাই ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার অন্য একটি লক্ষ্য ছিল অপরাবিদ্যার চর্চার মধ্য দিয়ে নিজ নিজ বর্ণ অনুযায়ী বিভিন্ন পেশার দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ নেওয়া।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

1 thought on “ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার লক্ষ্য গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো”

Leave a Comment