বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে আলােচনা করাে
উত্তর:
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান:
আধুনিক বাংলা সাহিত্য যার উপর ভিত্তি করে বিকাশ লাভ করেছে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার মূল পরিচয় কবি হিসাবে হলেও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি অবাধে পদচারণা করেছেন। বাংলা কবিতা, বাংলা নাটক, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য, বাংলা পত্রসাহিত্য, বাংলা ভ্রমণসাহিত্য, বাংলা গান প্রভৃতিতে তিনি উল্লেখযােগ্য অবদান রেখেছেন। বাংলা ছােটগল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ রবীন্দ্রনাথের হাতেই ঘটেছিল। এতসব করার পাশাপাশি সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথ বাংলা উপন্যাসেও যথেষ্ট অবদান রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ যখন সাহিত্য চর্চা শুরু করেন তখন বাংলা কাব্যক্ষেত্রে মধুসূদনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল মহাকাব্য রচনার যুগ, আর উপন্যাসের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র ও তার অনুগামীদের দ্বারা ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার যুগ। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববর্তীদের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না বলে মনস্থির করলেও যুগের অনিবার্য প্রভাব থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেননি। তাই যুগের প্রভাবেই তিনি প্রথমে ইতিহাসের কাহিনি অবলম্বনে “বৌঠাকুরনীর হাট ’(১৮৮৩) ও ‘রাজর্ষি’(১৮৮৭) নামে দুটি উপন্যাস রচনা করেন। তার ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসে রাজা প্রতাপাদৈত্য, তার পুত্র উদয়াদিত্য ও কন্যা বিভা এবং পিতৃব্য বসন্ত রায়ের ঐতিহাসিক কাহিনি এবং ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসে ত্রিপুরার রাজা গােবিন্দ মানিক্যের ঐতিহাসিক কাহিনি স্থান পেলেও এই দু’টি উপন্যাসে ইতিহাস এসেছে ডিমের খােলসের মত অর্থাৎ বাইরের আবরণের মত, যার ভেতরে বাস্তব নরনারীর হৃদয়গত কাহিনিই স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে তার “রাজর্ষি উপন্যাসটির নাট্যরূপ দেন ‘বিসর্জন’ নাম দিয়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য রবীন্দ্রনাথের ‘বৌঠাকুরণীর হাট’-কে প্রথম উপন্যাস হিসাবে ধরা হলেও এর আগে তিনি ভারতী’ পত্রিকায় ‘করুণা’ নামে একটি উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। কিন্তু এটি উপন্যাস হয়নি বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন এবং তা প্রকাশ করেন নি।
রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে ইতিহাসকে আশ্রয় করে পরপর দু’টি উপন্যাস রচনা করলেও পরবর্তীকালে আর ইতিহাসকে অবলম্বন করে উপন্যাস রচনা করেন নি। রাজর্ষি’ রচনার প্রায় ১৬বছর পর রবীন্দ্রনাথ তার চোখের বালি’ উপন্যাসটি রচনা করেন। পূর্ববর্তী দু’টি উপন্যাসে ইতিহাসের আড়ালে কাহিনির অবতাড়না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ‘চোখের বালি’র ক্ষেত্রে কাহিনি অর্থাৎ ঘটনা পরম্পরার বিবরণ না দিয়ে চরিত্র সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব দেন। এই উপন্যাসের বিনােদিনী, মহেন্দ্র, বিহারী, আশালতা, রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা প্রমুখ চরিত্রগুলি সৃষ্টি করে তাদের মনের কারখানা ঘরে প্রবেশ করে সেখান থেকে ‘আঁতের কথা বের করে আনেন। অনেকের মতে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ হল বাংলা ভাষার প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে, ঘটনা সংস্থাপণে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। চোখের বালি’র বিনােদিনী চরিত্রকে অনেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিকা নারীর স্বীকৃতি দেন।
‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করে নানা বিতর্ক বেঁধেছিল। হয়ত এই বিতর্কে জল ঢেলে দেবার জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চোখের বালি’ প্রকাশের তিন বছর পর ‘নৌকাডুবি’(১৯০৬) উপন্যাসটি প্রকাশ করেন। এটি মূলতঃ কাহিনি প্রধাণ উপন্যাস এবং চোখের বালি’র তুলনায় অনেকটাই নিকৃষ্ট মানের রচনা।
এরপর রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গােরা’(১৯১০) উপন্যাসটি রচনা করেন। বিভিন্ন কারনে ‘গােরা’ উপন্যাসটি আজও গুরুত্বপূর্ণ। এই উপন্যাসটি দেশ, কাল, সীমা প্রভৃতিকে অতিক্রম করে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি লাভ করে বাংলা সাহিত্যের একটি মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস হয়ে উঠেছে। “গােরা’ উপন্যাসের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তার নানা আদর্শ, নানা দর্শন, নানা ভাবনাকে ব্যক্ত করেছেন। উপন্যাসের কাহিনিতে দেখা যায় এক আইরিশ দম্পতির পরিত্যক্ত সন্তান গােরা হিন্দু পরিবারে প্রতিপালিত হয়ে নিজেকে হিন্দু ভাবে ও হিন্দু পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখে। আর একারনেই সে তার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীতে দেশকে খোঁজে। কিন্তু উপন্যাসের শেষে দেখা যায় তার সমস্ত খোজা ব্যর্থ হয় এবং মা আনন্দময়ীর কাছে সে সব প্রশ্নের জবাব পায়। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা কাটিয়ে উঠে বৃহত্তর মানবতার জয়গান গেয়েছেন। “গােরা’ উপন্যাসের গােরা ও তার মা আনন্দময়ী ছাড়াও আর দু’টি বিখ্যাত চরিত্র হল গােরার বন্ধু বিনয় এবং এই উপন্যাসের নায়িকা সুচরিতা।
‘গােরা’ উপন্যাসের পর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের দু’টি উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘ঘরে বাইরে’ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটি ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও বিশেষ তাৎপর্যবাহী উপন্যাস। এই উপন্যাসটিকে রবীন্দ্রনাথ আলাদা আলাদা নাম দিয়ে চারটি ভাগে ভাগ করে এই উপন্যাসের চরিত্র শ্রীবিলাসের মাধ্যমে কাহিনি বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসের নায়ক শচীশের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ জীবনের লক্ষ্য খুঁজেছেন। তাই আমরা দেখি শচীশ কখনাে জ্যাঠামশাই-এর সাথে পরােপকারের মতাে মহৎকার্যে জীবন
শাগত ক্ষুরাকৃতিক ভাগে ভাগ করে বন্দ্রনাথ জীবনের জীবন অতিবাহিত করতে চেয়েছে, আবার কখনাে বা লীলানন্দ স্বামীর প্রভাবে রসের জগতে পদচারণা করে মুক্তি খুঁজেছে। কিন্তু যখন কোথাও মুক্তি পায়নি তখন সে অরূপলােকে নিজের আত্মানুসন্ধান করেছে। উপন্যাসের নায়িকা দামিনী এই পার্থিব জগতের মাঝেই নিজেকে, নিজের প্রেমকে খুঁজেছে। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসেই প্রথম বিধবা রমণীর বিয়ে দিয়েছেন। যা রবীন্দ্র সৃষ্টির পক্ষে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
‘চতুরঙ্গ প্রকাশের বছরেই রবীন্দ্রনাথের আর একটি উপন্যাস ‘ঘরে বাইরে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। রবীন্দ্রনাথ নিজে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পথে নামলেও দেশ সেবার নামে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপকে তিনি যে সমর্থণ করতেন না, তা এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা জানি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মূল কর্মসূচী ছিল স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন। ফলে দেশবাসী বিদেশী দ্রব্য বয়কট ও স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণের জন্য পথে নেমেছিল। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন শুধু বিদেশি দ্রব্য বয়কট করলে চলবেনা, তার পরিপূরক স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদনও করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে উপন্যাসের চরিত্র নিখিলেশের মাধ্যমে। নিখিলেশের বন্ধু সন্দীপ উগ্র স্বদেশি। সে আপন বাকচাতুর্য দ্বারা জনমত গড়ে তুলে শুধু বিদেশি দ্রব্য বর্জনের কথাই ভাবত বিকল্প কোন চিন্তা করত না। উপন্যাসের নায়িকা নিখিলেশের পত্নী বিমলা ‘ঘরে-বাইরে’র-এই দ্বন্দের মাঝে পড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। উপন্যাসটি সন্দীপ, নিখিলেশ ও বিমলার আত্মকথনে রচিত।
‘চতুরঙ্গ’ ও ‘ঘরে বাইরে প্রকাশের পর দীর্ঘদিন রবীন্দ্রনাথের কোন উপন্যাস প্রকাশিত হয়নি। এরপর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘শেষের কবিতা’ ও ‘যােগাযােগ’ উপন্যাস দু’টি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘শেষের কবিতা উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পটভূমি হিসাবে প্রথম শহর কলকাতাকে বাদ দিয়ে শিলং পাহাড়কে গ্রহণ করেন। এই পাহাড়ের রােমান্টিক পরিবেশে অমিত-লাবণ্যের প্রেমকে দেখান। শেষের কবিতা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস হলেও অনেকটা কাব্যধর্মী রচনা। সমকালে রবীন্দ্র সাহিত্যে আধুনিকতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই প্রশ্নের জবাব দিতে চেয়েছিলেন। আর ‘যােগাযােগ’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ প্রথমে ‘তিনপুরুষ’ নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। এই উপন্যাসে তিন পুরুষের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাঙালী সমাজে সামন্ত্রতন্ত্রের অবক্ষয় ও ধনতন্ত্রের আগমণ ও উচ্ছঙ্খলতাকে দেখিয়েছেন।
এরপর রবীন্দ্রনাথ ‘দুইবােন’(১৯৩৩), ‘চার অধ্যায়’(১৯৩৪) এবং “মালঞ্চ’(১৯৩৪) নামক তিনটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি উপন্যাস হিসাবে ততটা উৎকৃষ্ট মানের রচনা নয়। চার অধ্যায়’-এ রবীন্দ্রনাথ দেশের জাতীয় সংকট মূহুর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল তার একটি রূপকে দেখাতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি এই উপন্যাসে অতীন্দ্ৰ-এলার প্রেমকেও দেখিয়েছেন। নারী যে দু’রূপে পুরুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে প্রিয়ারূপে এবং জননী রূপে এই তত্ত্বটি প্রতিপাদন করার উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘দুইবােন’ উপন্যাসটি রচনা করেছেন। এখানে নায়ক শশাঙ্ক এবং
দুইবােন শর্মিলা ও উর্মিমালার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস ‘মালঞ্চ’ মূলতঃ কাহিনি প্রধাণ উপন্যাস।
এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথ একের পর এক ভিন্নধর্মী উপন্যাস রচনা করে বাংলা সাহিত্যে তার অবদান রেখে গেছেন। রবীন্দ্র উপন্যাস পাঠ করতে গেলে যদি আমরা কাহিনি আশা করি তা হলে ভুল করব। তিনি প্রায় সব উপন্যাসেই কোন না কোন তত্ত্বের অবতাড়ণা করেছেন। বঙ্কিমের উপন্যাস যেমন আমাদের ইতিহাস চেতনাকে জাগিয়ে তােলে, শরৎচন্দ্রের উপন্যাস যেমন আমাদের হৃদয়বােধকে নাড়া দেয় তেমনি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের আবেদন আমাদের বুদ্ধির কাছে। যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করলেই রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান এখানেই।
Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।
লেখাগুলো অনেক ভালো,অসংখ্য ধন্যবাদ।