বাংলার সংস্কৃতি – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

বাংলার সংস্কৃতি

ভূমিকা : জাতিসত্তার বিকাশের ইতিহাসই হল তার সংস্কৃতি। মানবীয় আচার-আচরণ, শিক্ষাদীক্ষা সহ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির জন্ম হয়। কাজেই সংস্কৃতির দর্পণে ধরা পড়ে একটি জাতির বহু শত শতাব্দী ব্যাপ্ত সামাজিক ক্রিয়াকাণ্ড, শিল্পকীর্তি, শিক্ষা, রুচি, সাহিত্যবােধ বা সংগীতচর্চার মতাে নানা বিষয়। সবসময়ই যে এই চর্চা উন্নয়নমুখী হবে এমন নয়, অনেক সময় তার অবক্ষয় ঘটতেও দেখি। কিন্তু সব মিলিয়ে জীবনপ্রবাহের মতাে কৃষ্টির একটি প্রবাহকেও আমরা লক্ষ করি। নিরবচ্ছিন্ন ধারায় বৃষ্টির এই প্রবাহকেই বলা যেতে পারে একটি বিশেষ জাতির সংস্কৃতি।

বাঙালি সংস্কৃতির উদ্ভব : বাঙালি একটি মিশ্র জাতি। প্রাচীনকালে এই বদ্ধভূমিতে নেগ্রিটো বা নিগ্রবটু, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েড জনগােষ্ঠীর মানুষ বাস করত। তখনও আর্যরা এদেশে আসেনি। তারা নানারকম গাছ, পাথরকেই সেদিন পুজোর আসনে বসিয়েছিল। পরবর্তীকালে আর্যরা এদেশে এলে তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগােষ্ঠীর মানুষের মিলনের ফলে শুধু যে একটি মিশ্র জাতির উদ্ভব হল তাই নয়, সেইসঙ্গে আর্য-অনার্যের দেবদেবীরও মিলন ঘটল। তাদের উভয় সংস্কৃতির মিলনের ফলে একটি মিশ্র সংস্কৃতিরও জন্ম হল। এদেশে শক, হুন, পাঠান, মােগল, মুসলিম, খ্রিস্টান প্রভৃতি নানা জাতি-ধর্মের মানুষ এসেছে। পুরুষানুক্রমে এরাও বাঙালি বা বাঙালির সাংস্কৃতিক জগৎকে আপন করে নিয়েছেন। এইসব ভিনদেশিদের সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছে বাঙালিও।

সমন্বয়ের সাধক বাঙালি : বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বাঙালি চিরকালই সমন্বয়ের সাধক। এ শিক্ষা বাঙালি ইতিপূর্বেই পূর্বজন্মের কাছে পেয়েছে। মধ্যযুগের মানবতাবাদী সাধক চৈতন্যদেব একদিন এই সমন্বয়ের ডাক দিয়েছিলেন। শাক্তকবি উচ্চারণ করেছিলেন—

“ওই যে কালী কৃয় শিব রাম
সকল আমার এলােকেশী” 

উনবিংশ শতকে মানবতাবাদী সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও এই মুক্তমনের সাধনায় প্রভাবিত করেছিলেন গােটা বাংলা দেশকে। শুধু রামকৃয়, বিবেকানন্দ নন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামমােহন, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন ব্রাহ্রাও সমন্বয়বাদী ধর্ম, সাহিত্যসাধনার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সমগ্র বঙ্গভূমিতে। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায়, নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায় এই সমন্বয়বােধ, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের জ্ঞান, মানবিক চেতনাকে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। বাঙালির অন্তরে এই শিক্ষার ফলে উনবিংশ শতকের গােড়া থেকে সাহিত্য, ধর্ম, সংগীত, শিল্প, দর্শন, বিজ্ঞান—সর্বক্ষেত্রেই বাঙালি বিশ্ব সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করতে শুরু করেছে।

বিশ্বায়ন ও বাঙালি সংস্কৃতি : বর্তমান যুগ হল বিশ্বায়নের যুগ। আজকের এই হাই টেকনােলজির যুগে জাতিসত্তা ও তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে লােকায়ত স্তরের সংস্কৃতি যেমন ব্রত-পার্বণ, স্ত্রী-আচার, বিবাহ বা পারলৌকিক ক্রিয়া কিংবা অন্য কোনাে সামাজিক উৎসব, পাঁচালি, কীর্তন, যাত্রার মতাে সংস্কৃতির নানা দিকগুলি আজ নগরায়ণের ধাক্কাতে এবং বিশ্বায়নের ফলশ্রুতিতে অনেকটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির পরিপন্থী পশ্চিমি কৃত্রিম সংস্কৃতি আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎকে আচ্ছন্ন করেছে। নতুন এই সংস্কৃতিকে অনেকেই অপসংস্কৃতি বলে দূরে সরিয়ে রাখেন। কাউকে বর্জন করে নয়, সকলকে ভালােবেসে বুকে নিয়ে এগিয়ে চলাই সংস্কৃতির লক্ষ্য।

উপসংহার : সংস্কৃতি মানুষের অর্জিত সম্পদ। এ সম্পদ বস্তুগত নয়, এ সম্পদ মানুষের ঐতিহ্যগত। বাঙালি যুগ যুগ ধরে পরম্পরাগতভাবে এই ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে রক্তে। আর পরম্পরাগত সেই রক্তই বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে।

আরো পড়ুন

বাঙালির উৎসব/বাংলার উৎসব – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

তোমার প্রিয় উপন্যাস – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

তােমার প্রিয় কবি – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

তােমার প্রিয় লেখক – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

পশ্চিমবাংলার হস্তশিল্প – বাংলা প্রবন্ধ রচনা

Read More »

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment