শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান লেখাে

শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান লেখাে

উত্তর:

শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকে রবীন্দ্রনাথের অবদান : 

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি হল—বিশ্বপ্রকৃতি ও জীবন। এটি কোনাে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত নয়। তিনি যা-কিছু সত্য ও সুন্দর তা নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছিলেন তার প্রতিফলন তার অমর সৃষ্টির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি হলেন ভাববাদী আবার অন্যদিকে তিনি প্রকৃতবাদী (naturalist) তাঁর শিক্ষাদর্শনের উল্লেখযােগ্য দিক হল— 

[1] প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক : প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে শিশুকে শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ রেখে পাঠদান করলে তার। বিকাশ সম্পূর্ণ হয় না। তাই প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমিক প্রথার। প্রতি আস্থা রেখে ব্রহ্মচর্যাশ্রম নামে শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত প্রান্তরে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। যেখানে শিশুর সঙ্গে প্রকৃতি সংযােগ হবে

[2] ভারতীয় সংস্কৃতি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমন্বয় : তিনি। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রহণ করেছিলেন। এ ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য—উপাসনা, ব্রহ্মচর্য ইত্যাদি। আবার। পাশ্চাত্য দেশগুলির আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাকেও শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রহণ করেছেন।

[3] শিক্ষায় আনন্দ : রবীন্দ্রনাথের মতে আনন্দের মধ্য দিয়ে প্রকৃত শিক্ষালাভ হয়। পুথিগত শিক্ষা শিক্ষার্থীকে আনন্দ  দিতে পারে না। তাই তিনি বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কাজকে পাঠক্রমে স্থান দিয়েছিলেন। 

[4] শিক্ষায় স্বাধীনতা : তিনি শিক্ষা ও কর্মে মানুষকে স্বাধীনতাদানের ব্যাপারে মতপােষণ করতেন। তিনি মনে করতেন শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা দিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা গড়ে উঠবে। কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে শিশুর প্রয়ােজন অবাধ স্বাধীনতা। যার মধ্য দিয়ে শিশুর চিন্তা, বিচার শক্তি, মেধার বিকাশ ঘটবে। 

[5] শিক্ষায় সৃজনশীল পরিবেশ সৃষ্টি : রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার পরিবেশ এমন হবে যেখানে শিশুর সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের সুযােগ থাকে। তাই তিনি শিক্ষাব্যবস্থায়। অঙ্কন, শিল্প, ভাস্কর্য প্রভৃতি সৃজনাত্মক কর্ম অঙ্গীভূত করেছিলেন। যার মধ্য দিয়ে শিশুর চিত্তবিকাশ ঘটে। 

[6] শিশুর বিকাশ : শিশুর সার্বিক বিকাশের ব্যাপারে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাঁর শিক্ষাদর্শনের একটি দিক হল ব্যক্তিসত্তার বিকাশ। শিক্ষা যেমন তার অন্তর্নিহিত সত্তাকে উন্মােচিত করবে, তেমনি তার শিক্ষার্থীর মন, আত্মা ও দেহের পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক হবে।

[7]সক্রিয়তার মাধ্যমে পাঠলাভ: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সক্রিয়তা। খেলাধুলাের মধ্য দিয়ে শিশুরা সক্রিয়তা প্রকাশ করবে। আবার পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি কর্মসম্পাদনের মধ্য দিয়ে সক্রিয়তা প্রদর্শন করবেন। তিনি শ্রীনিকেতন গড়ে তুলেছেন কর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে। তিনি তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনায় কর্ম ও খেলা উভয়কে সমান গুরুত্ব প্রদান করেছেন। 

উপসংহার : রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন জাতির জীবনের নতুন আলাের দিশারি। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর দর্শন এ যুগের সাথে অত্যন্ত সময়ােপযােগী। বাঙালি জাতি তথা ভারতবাসী এই শিক্ষা দার্শনিক-এর কাছে চিরঋণী।

ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান :

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়িত রূপ পেয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। 

[1] আশ্রম প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা : বােলপুরে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে শিক্ষক-ছাত্র প্রকৃতির ছায়াস্নিগ্ধ কোলে পাঠলাভ করবে। এটি হল তার প্রাচীন ভারতের আশ্ৰমিক শিক্ষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আশ্রমিক শিক্ষার বিশেষ উল্লেখযােগ্য দিক হল— 

• শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ রাখার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে তিনি পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করেছিলেন।

• শান্তিনিকেতনের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল— ভারতীয় কৃষ্টি ও আধ্যাত্মিকতা শিক্ষাদান।

• সাংস্কৃতিক উৎসব, খেলাধুলাে, অভিনয় ইত্যাদি শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করা হত। রবীন্দ্রনাথ নিজেও অংশগ্রহণ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি বহু গান, আবৃত্তি, গীতিনাট্য প্রভৃতি রচনা করেছেন।

• শান্তিনিকেতনের শিক্ষার আর-এক উল্লেখযােগ্য বিষয় হল। সমাজসেবা।

[2] বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: 1921 খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। তা বর্তমানে বিশ্বভারতী নামে পরিচিত। বিশ্বভারতীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ের চর্চা হয়।।

• শিক্ষার জন্য সেখানে রয়েছে— “শিশুভবন’, শিশু শিক্ষার জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয় হল— পাঠভবন’। উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাভবন’। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য ‘বিদ্যাভবন’।

• শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়ােজন যােগ্য প্রশিক্ষক। তার জন্য শিক্ষক-শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় হল ‘বিনয় ভবন’।।

• নান্দনিক বিকাশের জন্য রয়েছে—কলাভবন’ (শিল্প ও চারুকলা) এবং সংগীত ভবন’ (সংগীত ও নৃত্য মহাবিদ্যালয়)।

• পল্লি উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান হল “শ্রীনিকেতন।

• নানা রূপ কুটিরশিল্প, তাঁতশিল্প, কাঠের কাজ, কৃষিকাজ প্রভৃতিতে শিক্ষা দেওয়ার জন্য রয়েছে— “শিল্পসদন’ (শিল্পশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়)।

• আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হল—“চিনাভবন’ (চিনা, তিব্বতি, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান)।

উপসংহার : রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা কেবলমাত্র তাত্ত্বিক দিয়ে সফল নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্যাবহারিক | দিক দিয়েও সফল, যা আজ আন্তর্জাতিক মানের।

Note: এই আর্টিকেলের ব্যাপারে তোমার মতামত জানাতে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে গিয়ে কমেন্ট করতে পারো। ধন্যবাদ।

Leave a Comment